এত উপদেষ্টা দিয়ে কী পাচ্ছে বিএনপি

ব্যক্তি থেকে সংগঠন,প্রতিষ্ঠান থেকে দল্- সব ক্ষেত্রেই কমবেশি উপদেষ্টার প্রয়োজন হয়। আগের আমলের রাজরাজড়াদেরও যেমন উপদেষ্টা ছিল, এখন প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি, বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রীদের আছে।

দেশের প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপিরও আছে একটি উপদেষ্টা পরিষদ। তবে সব রাজনৈতিক দলের উপদেষ্টা পরিষদের তালিকাকে ছাড়িয়ে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টার তালিকাটা এত লম্বা যে,খোদ দলের নেতারাই সবার নাম জানেন না।

আর মাথাভারী হলে যা হয়, উপদেষ্টা পরিষদ তার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছে না বলে দলের ভেতরেই সমালোচনা হচ্ছে। নেতাকর্মীদের যুক্তি, আমলানির্ভর উপদেষ্টারা চেয়ারপারসনকে সঠিক সময়ে রাজনৈতিক পরামর্শ দিতে ব্যর্থ হচ্ছেন। দলের করুণ অবস্থার জন্য তাদের দায়ী করছেন অনেকে।

শুধু নেতাকর্মীরা নয়,উপদেষ্টা পরিষদেরও কেউ কেউ এই তালিকা ছোট করার পক্ষে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন উপদেষ্টা ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এতজন উপদেষ্টার কী দরকার আছে আমার বুঝে আসে না। চেয়ারপারসনের উচিত হবে নতুন করে আন্দোলন কর্মসূচি নিয়ে ভাবার আগে এসব বিষয়ে নতুন করে চিন্তা করা। সবাইকে কাজে লাগানো।”

দলের তথ্যমতে, বেগম খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা ৩৭ জন। তবে সংখ্যা নিয়ে ভিন্নমত আছে। কেননা নেতাকর্মীরা চেনেন হাতে গোনা কয়েকজনকে। অনেকের নাম দেখেছেন, কিন্তু চেহারা দেখেননি। আন্দোলন-সংগ্রাম তো দূরের কথা ঘরোয়া অনুষ্ঠানেও অনেকের উপস্থিতি চোখে পড়ে না। বেশ কয়েকজন বেঁচে নেই। আর একজন মেয়র নির্বাচনে হেরে রাজনীতি থেকে অবসর নিয়েছেন।

তবে নিস্ক্রিয় উপদেষ্টা যেমন আছেন, তেমনি আছেন বেশ সক্রিয় উপদেষ্টাও। তাদের কেউ দলের চেয়ারপারসনসহ আটক শীর্ষ নেতাদের মামলা নিয়ে আদালত প্রাঙ্গণে দৌড়ঝাপ করছেন। কেউ আবার আন্তর্জাতিক মহলের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছেন। কেউ বিএনপিপন্থী আমলাদের সঙ্গে যোগাযোগ ধরে রাখছেন। কাউকে কাউকে দল ও সহযোগী সংগঠনের ঘরোয়া অনুষ্ঠানেও দেখা যাচ্ছে। কেউ আবার টকশোতে ভূমিকা রাখছেন।

এভাবেই চলছে দলের প্রতিষ্ঠার পর থেকে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি-প্রধানের উপদেষ্টা পরিষদ।

এখন দেখা যাক উপদেষ্টাদের বর্তমান অবস্থান।

২০০১ সালে খালেদা জিয়ার ছেড়ে দেয়া আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন প্রবীণ আইনজীবী অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব উদ্দিন আহমাদ। গত বছরের মার্চ মাসে তিনি মারা যান।

বেঁচে নেই ফেনী জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি মোশাররফ হোসেনও।

আর একজন উপদেষ্টা হলেন সফল ব্যবসায়ী হারুনার রশিদ খান মুন্নু। তিনি বার্ধক্যজনিত কারণে এখন আর রাজনীতিতে সক্রিয় নেই।

অনেক দিন ধরে অসুস্থতার কারণে রাজনীতিতে সক্রিয় নন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উকিল আবদুস সাত্তারও।

তবে সুস্থ থাকলেও এই ব্রাহ্মণবাড়িয়ারই নেতা সাবেক সচিব মুশফিকুর রহমানকে রাজনীতিতে খুব বেশি সক্রিয় দেখা যায় না।

তেমন একটা তৎপরতা নেই সাবেক ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী নাটোরের ফজলুর রহমান পটলের।

সরকারবিরোধী আন্দোলনের সময় নাশকতার মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে অনেক দিন ধরে কারাগারে আছেন আরেক উপদেষ্টা গাজীপুরের মেয়র অধ্যাপক এম এ মান্নান।

সাবেক কূটনীতিক ও প্রতিমন্ত্রী রিয়াজ রহমান গত আন্দোলনের সময় দুর্বৃত্তদের গুলিতে আহত হওয়ার পর থেকে এখনো অনেকটা অন্তরালে।

সাবেক সচিব জহুরুল ইসলামকে চেনেন না অনেকেই। তাকে কেন্দ্রীয় রাজনীতি দূরের কথা, রাজশাহীর রাজনীতিতে কালেভদ্রে দেখা যায়।

আইনজীবী উপদেষ্টা ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর। বেশির ভাগ সময় ব্যস্ত থাকেন নিজের পেশাগত কাজে। নেতাকর্মীদের অভিযোগ, তার কাছ থেকে আইনি সহায়তা পান না কেউ। উপরন্তু কর্মীদের সঙ্গে ‘দুর্ব্যবহারের’ অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে।

খুলনার নেতা অধ্যাপক মাজেদুল ইসলামকে রাজনীতিতে তেমন সক্রিয়তা দেখা না গেলেও মাঝে মাঝে গুলশান অফিসে তার যাওয়া-আসা নজরে পড়ে।

ঢাকা জেলা বিএনপির সভাপতি ও উপদেষ্টা আবদুল মান্নানকেও খুব বেশি সক্রিয় দেখা যায় না।

আর রাজনীতি থেকে ইতিমধ্যে অবসরের ঘোষণা দিয়েছেন চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র এম মঞ্জুর আলম।

সক্রিয় উপদেষ্টারা কী করছেন

উপদেষ্টাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় ও সরব প্রবীণ আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন। সব দিকেই নিজের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন তিনি। বিভিন্ন কর্মসূচিতে যেমন তার উপস্থিতি চোখে পড়ে নিয়মিত, তেমনি নেতাকর্মীদের মামলা পরিচালনা, জামিনের বিষয়ে ভূমিকা রাখছেন তিনি।

নিজের পেশাগত জায়গা থেকে দলের পাশে থেকে ভূমিকা রাখছেন আরেক আইনজীবী এ জে মোহাম্মদ আলীও।

আরেক আইনজীবী আহমদ আযম খানকে দলের বিভিন্ন কর্মসূচিতে নিজ জেলা টাঙ্গাইলে বেশ দেখা যায়। পাশাপাশি ঢাকাতেও তার উপস্থিতি লক্ষ্ করা গেছে। টেলিভিশনের টকশোতেও প্রতিনিয়ত কথা বলেন তিনি।

মামলার আসামি হয়ে অনেকটা ফেরারি হলেও অধ্যাপক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেনকে সব সময় সক্রিয় দেখা যায়।

শামসুজ্জামান দুদু মিডিয়া ও কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে যথেষ্ট সক্রিয়। গত আন্দোলনের সময় বেশ কিছুদিন তিনি জেল খেটেছেন। দলের দুঃসময়ে তিনি দলের মুখপাত্রের দায়িত্বও পালন করেছেন কয়েকবার।

চট্টগ্রাম মহানগরের সভাপতি আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীকে গত আন্দোলনে সক্রিয় দেখা গেছে মাঠে, গণমাধ্যমে। একই সঙ্গে তিনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গেও দলের যোগাযোগ রক্ষা করছেন। বর্তমানে লন্ডনে অব্স্থান করছেন খালেদার আস্থাভাজন সাবেক এই মন্ত্রী।

সাবেক সেনা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল (অব.) মাহমুদুল হাসান

জাতীয় পার্টি থেকে বিএনপিতে এসে উপদেষ্টা বনে যান। টাঙ্গাইলের রাজনীতির পাশাপাশি কেন্দ্রীয় কর্মসূচিতেও মাঝে মাঝে দেখা যায় তাকে।

সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ড. ওসমান ফারুক ৫ জানুয়ারি আন্দোলনের আগে থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ছিলেন। সেখানে তিনি দলীয় প্রধানের নির্দেশনায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে কাজ করেছেন। বর্তমানে তিনি দেশে আছেন।

রাজনীতিবিদ,ব্যবসায়ী এবং জিয়া পরিবারের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে সমধিক পরিচিত মোসাদ্দেক আলী ফালু কিছুদিন কারাগারে থাকলেও বর্তমানে মুক্ত আছেন। দলের আর্থিক জোগানে তার ভূমিকা প্রধান বলে জানা যায়।

দলের জন্য অর্থের জোগান দিতে অগ্রণী ভূমিকা রাখছেন আরেক উপদেষ্টা আবদুল আউয়াল মিন্টু।

নিয়মিত টকশোতে দেখা যায় সাবেক আমলা ইনাম আহমেদ চৌধুরীকে্।

দাদু ভাই নামে পরিচিত খুলনার এই রাজনীতিক বার্ধক্যে পৌঁছে গেছেন। তারপরও দলের হয়ে কাজ করছেন বলে জানান স্থানীয় নেতাকর্মীরা।

সাবেক আমলা এ এস এম আবদুল হালিম ঘরোয়া অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার পাশাপাশি বিএনপিপন্থী আমলাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছেন বলে জানা গেছে।

সাবেক সেনা কর্মকর্তা মেজর জে. (অব.) রুহুল আলম চৌধুরী

খালেদা জিয়ার নিরাপত্তাবিষয়ক উপদেষ্টা। মাঠে-ময়দানে খুব বেশি না থাকলেও গুলশান অফিসে তার আসা-যাওয়া বেশ।

আরেক আমলা সাবিহ উদ্দিন আহমেদ। দলের কর্মসূচিতে মাঠের রাজনীতিতে না থাকলেও পররাষ্ট্র বিষয়টি দেখভাল করতেন। এখনো করেন তবে আগের মতো নয়। গ্রেপ্তার এড়াতে গত আন্দোলনের সময় রাজনীতি থেকে অবসরের মুচলেকা দেয়ার অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে।

সাংবাদিক নেতা শওকত মাহমুদ সব জায়গাতে সক্রিয় থাকলেও বেশ কিছুদিন ধরে কারাগারে আছেন।

আরেক সাবেক সচিব ব্যারিস্টার মুহম্মদ হায়দার আলীকে

ঘরোয়া অনুষ্ঠানের বাইরে টকশোতে দেখা গেছে।

সাবেক পুলিশের আইজি এম এ কাইয়ুম গুলশান অফিসের বেতনভুক্ত প্রধান কর্মকর্তা হিসেবে বর্তমানে দায়িত্ব পালন করছেন বলে একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে। প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার দায়িত্ব পালন করছেন বলে জানা গেছে।

সাবেক সচিব খন্দকার শহিদুল ইসলাম ঝিনাইদহের শৈলকুপার রাজনীতিতে কিছুটা সক্রিয় বলে জানা গেছে।

ক্যাপ্টেন (অব.) সুজাউদ্দিনকে মাঝেমধ্যে সংবাদ সম্মেলন ও ঘরোয়া অনুষ্ঠানে দেখা যায়।

বয়স হলেও সাবেক মন্ত্রী মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন কেন্দ্রের পাশাপাশি চট্টগ্রামের স্থানীয় রাজনীতিতে ভূমিকা রাখছেন বলে জানা গেছে।

মিডিয়াবান্ধব ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু কেন্দ্রে সক্রিয় না থাকলেও রাজনীতিতে সক্রিয়। তবে স্থানীয় রাজনীতিতে তাকে নিয়ে ব্যাপক অসন্তোষ রয়েছে বলে জানা গেছে।

খন্দকার অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন বিএনপির গ্রেপ্তার নেতাকর্মীদের পাশে থেকে আইনি সহায়তা দিচ্ছেন।

এ ছাড়া দলটির শীর্ষ পর্যায়ের বেশির ভাগ নেতার মামলা তিনি দেখাশোনা করছেন।

জানা গেছে, খুলনার (বরখাস্ত) মেয়র মনিরুজ্জামান মনিকেও উপদেষ্টা করেছেন খালেদা জিয়া।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চেয়ারপারসনের একজন উপদেষ্টা বলেন, “উপদেষ্টার সংখ্যা কমানো বা বাড়ানো চেয়ারপারসনের ওপর নির্ভর করে। তিনি চাইলে কমতে পারে, বাড়তেও পারে। এ নিয়ে কিছু বলার নেই।”

আরেক উপদেষ্টা ড. ওসমান ফারুক বলেন, “বিষয়টি হয়তো ভাবা দরকার। সবাইকে আলাদা আলাদা দায়িত্ব দেয়া হলে এবং কাজে লাগাতে পারলে তা উপকারে আসবে। তবে সবই চেয়ারপারসনের ওপর নির্ভর করে।”

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর