ইসলামী ইন্স্যুরেন্স : হালাল-হারাম নামনির্ভর নয়

আরেকটু স্পষ্ট করে বলা যায়, মনে করুন! একটা লোকের নাম ‘নির্মল’ বা ‘বিমল’ বা ‘বিপ্লব’ যার অর্থও একেবারে খারাপ বা তেমন মন্দ নয়! পরিষ্কার বা পরিচ্ছন্ন, ময়লামুক্ত ও ইনকিলাব-সংগ্রাম। আমাদের কোরআনের শব্দ ‘তাযকিয়া’ বা ‘তাসফিয়া’ ও জিহাদ-সংগ্রাম এর কাছাকাছি অর্থ। এখন এই নামের কেউ যদি মুসলমান হয় বা একজন মুসলমান এমন নাম ধারণ করেন; কিন্তু তার কাজ-কর্ম, ইবাদত-বন্দেগি সব শরিয়ত মতে ঠিক থাকে; তা হলে শরিয়ত কি তাকে একজন মুসলমান বলে স্বীকৃতি দেবে না? অবশ্যই দেবে; যদিও নামটি আরবি শব্দে হয়নি। এক্ষেত্রে বেশির চেয়ে বেশি শরিয়ত এটুকু বলতে পারে, ‘আরবি ভাষায় হলে বা দাসত্ব প্রকাশ পায় এমন হলে বা আল্লাহ ও রাসুল (স.) এর নামের সঙ্গে মিল করে নাম রাখলে, অধিক ভালো হতো!’

ইসলামী ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি অনেকটা সমবায়ভিত্তিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানের শেয়ারহোল্ডার বা মালিক এবং পলিসি হোল্ডাররা পারস্পরিক সহযোগিতা ও সংহতির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠানটির আয় এবং দায়-দায়িত্ব ভাগাভাগি করে নেন।
পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতা, দান-অনুদান অবশ্যই পুণ্যের কাজ। আল্লাহ্র সন্তুষ্টির জন্য জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে আমরা চিনি বা না চিনি, জানি বা না জানি, যে কোনো মানুষকেই সাহায্য করা যায়।
১০০ বা ৫০০ বা ১ হাজার লোকও যদি একত্র হয়ে প্রতিজ্ঞা করে যে, আমরা কারও বিপদ-আপদে সাহায্য করব বা পরস্পরকে সাহায্য করব এবং তার দুঃখ-যাতনায় বা অভাব দূরীকরণে আর্থিকভাবে এগিয়ে যাব; তা কি ইসলামবিরোধী হতে পারে?
১০০ লোক যদি এমন হলফ করে যে, তারা সবাই একটা সাধারণ তহবিলে মাসে ১০০ টাকা হারে জমা করবে; আর সে টাকায় যা লাভ হয় তা পূর্ব- নির্ধারিত নীতিমালা ও শর্ত অনুযায়ী ভাগ করে নেবেÑ তা কি শরিয়তবিরোধী হবে? যেখানে হাদিসে বলা হয়েছেÑ “মুসলমানরা তাদের পাস্পরিক শর্তানুযায়ী আমল করতে পারে।”
১০০ লোক প্রতি মাসে ১০০ টাকা হারে জমা করলে এক বছরে হবে এক লাখ ২০ হাজার টাকা। এ থেকে দ্বিতীয় বছরে সম্ভাব্য ন্যূনতম লাভ হবে ১২ হাজার টাকা। এই ১০০ লোক যদি সম্মত হয়ে শর্ত করে যে, ‘আমরা এ বছর যদি আমাদের মধ্যে কেউ মারা যায়, তা হলে নিজেরা কোনো লাভ না নিয়ে, ওই এক লাখ ২০ হাজারের পুরো আয় ওই মৃত সদস্যের পরিবারকে সাহায্যার্থে তা দান করে দেব।’ তা হলে সেটি কি ইসলামবিরোধী হয়ে যাবে? না, কক্ষণও হবে না। আর এরই নাম হচ্ছে ইসলামী ইন্স্যুরেন্স।
যদিও আমরা বাহ্যিক দৃষ্টিতে দেখতে পাচ্ছি, দৈব দুর্বিপাক ও বিপদগ্রস্ত লোককে সাহায্যের সেøাগান নিয়ে পাশ্চাত্যের লোকেরা এ ইন্স্যুরেন্স সিস্টেম চালু করেছে; তা প্রকৃত অর্থে বাস্তব নয়। বাস্তবে এটা হচ্ছে ইসলামের আদর্শ। ইসলাম এ আদর্শ মুসলিম উম্মাকে অনেক আগেই শিক্ষা দিয়েছে এবং মুসলমানরা তা হাজার বছর আগে থেকেই লালন ও পালন করে আসছে। ইসলামের ইতিহাস ঘাটলে তার ভূরি ভূরি প্রমাণ পাওয়া যাবে। তবে হ্যাঁ, এটুকু বলা যায়, তার প্রাতিষ্ঠানিকরূপ প্রদানে অন্যরা অগ্রগামী হয়ে গেছে; যেখানে অগ্রগামী হওয়ার কথা ছিল আমাদের, মুসলমানদের।
শরিয়া বিষয়ে মুসলিম উম্মাহকে সহিহ নির্দেশনা বা সঠিক সিদ্ধান্তদানের মতো যথাযোগ্য একজন আলেম বা মুফতির কাজ হচ্ছে, মৌলিক বোধÑ বিশ্বাসকেন্দ্রিক বিষয় হোক বা ইবাদত-আমল হোক বা বিয়ে-শাদি ও সামাজিক বিষয়াদি হোক বা লেনদেন ও ব্যবসায়-বাণিজ্য বিষয়ক কিছু হোক; তা যদি নামে ও কাজে সর্বোত্তম তিন যুগে এবং গবেষক ইমামদের যুগে পরিচিত ও জানাশোনা বিষয় হয়ে থাকে; তা হলে তাঁরা যেভাবে সংশ্লিষ্ট বিষয়টিতে ফায়সালা-সিদ্ধান্ত দিয়ে গেছেন এবং কোরআন-সুন্নাহ্ ও তা‘আমুল (পারস্পারিক আমল ও আচরিত রীতি)  মোতাবেক যে দিকনির্দেশনা প্রদান করে গেছেন; ঠিক সেভাবেই আমাদের হালাল-হারাম বা বৈধ-অবৈধ ফায়সালা দিয়ে যেতে হবে। তার ব্যতিক্রম করার কোনো সুযোগ শরিয়তে নেই; যেমন সালাত, সওম, হজ, জাকাত ইত্যাদি বিষয়ে।
বিষয়টি যদি এমন হয় যে, দেশ-দেশান্তরের  ভাষা-সাহিত্য ও সংস্কৃতিক কারণে নামে পরিবর্তিত হয়েছে বটে, তবে বাস্তব কাজে সে একই বিষয়, একই আমল; তা হলে সেক্ষেত্রে সে মূলের অনুরূপ তা-ও বৈধ বা অবৈধ বলে গণ্য হবে। যেমন ‘সালাত’, ‘সওম’ আমল দুটির নাম পরিবর্তিত হয়ে, পারস্য অঞ্চলে ও উপমহাদেশে ‘নামাজ’ ও ‘রোজা’ নামে পরিচিত ও প্রচলিত হয়ে আছে। এতে শরিয়তে কোনো সমস্যা নেই। কারণ, মূল কাজ বা অমল সেই একই।
আরেকটু স্পষ্ট করে বলা যায়, মনে করুন! একটা লোকের নাম ‘নির্মল’ বা ‘বিমল’ বা ‘বিপ্লব’ যার অর্থও একেবারে খারাপ বা তেমন মন্দ নয়! পরিষ্কার বা পরিচ্ছন্ন, ময়লামুক্ত ও ইনকিলাব-সংগ্রাম। আমাদের কোরআনের শব্দ ‘তাযকিয়া’ বা ‘তাসফিয়া’ ও জিহাদ-সংগ্রাম এর কাছাকাছি অর্থ। এখন এই নামের কেউ যদি মুসলমান হয় বা একজন মুসলমান এমন নাম ধারণ করেন; কিন্তু তার কাজ-কর্ম, ইবাদত-বন্দেগি সব শরিয়ত মতে ঠিক থাকে; তা হলে শরিয়ত কি তাকে একজন মুসলমান বলে স্বীকৃতি দেবে না? অবশ্যই দেবে; যদিও নামটি আরবি শব্দে হয়নি। এক্ষেত্রে বেশির চেয়ে বেশি শরিয়ত এটুকু বলতে পারে, ‘আরবি ভাষায় হলে বা দাসত্ব প্রকাশ পায় এমন হলে বা আল্লাহ ও রাসুল (স.) এর নামের সঙ্গে মিল করে নাম রাখলে, অধিক ভালো হতো!’ আর এটি সবাই জানেন যে, ‘ভালো’ বা ‘অধিক ভালো’ বিষয়গুলো আপেক্ষিক, যার কোনো শেষ নেই। যে কারণে আইন এসব ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ির সুযোগ দেয় না। সুতরাং ‘ইন্স্যুরেন্স’ বা ‘তাকাফুল’ নামটির আড়ালের অর্থ যদি ভালো হয়, পারস্পরিক কল্যাণ সাধন যদি লক্ষ্য ও মুখ্য হয়, সঞ্চিত ও আহরিত অর্থ যদি শরিয়তের বৈধ ও হালাল ব্যবসায়-বাণিজ্যের পদ্ধতি-প্রক্রিয়ায় বিনিয়োগ করে মুনাফা অর্জন করা হয়। যেমন মুদারাবা, মোরাবাহা, মুশারাকা ও বাইয়ে সালাম ইত্যাদি এবং তা থেকে পূর্ব-স্থিরিকৃত কর্ম-কৌশল ও বৈধ শর্তাবলির আওতায় বিনিয়োগকারীদের একটা অংশ, যাবতীয় খরচ বাবদ একটা অংশ এবং ঝুঁকি মোকাবিলায় একটা অংশ প্রদান করা হয়; তা তো শরিয়ত মোতাবেক হালাল না হওয়ার কোনো কারণ থাকতে পারে না!
আর যদি এমন হয়, ঝুঁকি মোকাবিলায় শুরুতেই পূর্ব-শর্ত ও সম্মতি মোতাবেক প্রিমিয়ামের ৫% বা ২% হারে শেয়ারহোল্ডাররা প্রদান করে থাকেন বা রাখা হয়; সেটি তো আরও উত্তম (যা কিনা আমাদের জানা মতে ফারইস্টসহ বিভিন্ন ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি করে থাকে)। সুতরাং যারা মূল বিষয়টি কী, কী করা হয়, কীভাবে করা হয়, পন্থা-পদ্ধতি-প্রক্রিয়া কেমন – এসব ভালো করে না জেনে, না বুঝে শুধু ‘বিমল’, ‘নির্মল’ ও ‘বিপ্লব’ বা ‘ইন্স্যুরেন্স’ নাম দেখেই ‘হারাম’ বা ‘না-জায়েজ’ বা ‘সুদি’ বলে ফেলেন কিংবা ‘ফাতওয়া’ দিয়ে বসেন; তারা আর যাই হোন না কেন, একজন মুহাক্কিক আলেম বা মুফতি হতে পারেন না।
আর বিষয়টি যদি এমন হয় যে, নামে সেই সহিহ-সঠিক, শরিয়তসম্মত; কিন্তু কাজে-কর্মে, বোধ-বিশ্বাসে সম্পূর্ণ ভিন্ন বা অসহনীয় মাত্রার ভিন্নতা রয়েছে; তা হলে নাম সহিহ হলেও, সে নাম বা নামধারীদের বা তাদের তেমন কর্মকা-কে বৈধ বলা হবে না, বলা যাবে না। যেমন কাদিয়ানীদের ‘ইসলাম’-কে বা তাদের নামাজ-রোজাকে বৈধতার সিদ্ধান্ত বা স্বীকৃতি প্রদান করা জায়েজ হবে না।
ঠিক তেমনি কেবল নামে ইসলাম বা ইসলামী দেখে কিংবা মুদারাবা, মুশারাকা ইত্যাদি শরয়ি হালাল ব্যবসার টার্মগুলো যদি ফরমে, সাইনবোর্ডে থাকে অথচ বাস্তবে এগুলো অনুসরণ করা না হয় এবং তা তদারকি করার মতো শরিয়তের ব্যবসায়-বাণিজ্য অধ্যায় ভালো বোঝেন এমন কোনো আলেম বা শরিয়া বোর্ড না থাকে; সেক্ষেত্রে নামে মুসলমান বা নামে ‘শরিয়াভিত্তিক পরিচালিত’ হওয়ারও কোনো মূল্য নেই। তেমন কোনো কোম্পানি বা অর্থলগ্নী প্রতিষ্ঠানকে শরিয়তসম্মত বলা এবং তাদের ব্যবসায়-বাণিজ্যকে হালাল বলা যাবে না।

লেখক : মুফতি, বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশন

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর