রাজস্ব ঘাটতিতে অর্থমন্ত্রীর ক্ষোভ অসন্তোষ

চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) রাজস্ব আদায়ে ব্যাপক ঘাটতিতে ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তিনি বলেছেন, রাজস্ব আদায়ের হার নিয়ে আমি আনহ্যাপি। এটা ব্যাড সিগন্যাল। গত ৫ বছরে এত কম রাজস্ব আদায় হয়নি। বড় ধরনের এ বিপর্যয়ের জন্য এনবিআর কর্মকর্তাদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলকে দায়ী করেছেন তিনি।
অর্থমন্ত্রী বলেন, রাজস্ব প্রশাসনে পরিবর্তনে কর্মকর্তাদের কারও কারও অসন্তোষ থাকতে পারে। আমলাদের মধ্যে এক ধরনের গ্রুপিং-ট্রুপিংও থাকে। প্রশাসনে পরিবর্তন হলে কেউ কেউ অসন্তুষ্ট হয়। আগে রাজস্ব বোর্ড যেভাবে চলত এখন হয় তো সেভাবে চলছে না। তবে আমি রাজস্ব বোর্ড চেয়ারম্যানকে এসব ছোটখাটো বিরোধ মিটিয়ে ফেলতে বলেছি এবং রাজস্ব আদায়ের বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে বলেছি।
সচিবালয়ে মঙ্গলবার দুপুরে রাশিয়ান ফেডারেশন ন্যাশনাল নিউক্লিয়ার কর্পোরেশন রোসাটোমের উপ-প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এইচএন স্পাসকির সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন। ঢাকায় রাশিয়ান ফেডারেশনের রাষ্ট্রদূত নিকোলাভ এ সময় উপস্থিত ছিলেন। রাজস্ব আদায়ের ব্যর্থতা সম্পর্কে সাংবাদিকরা জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী বলেন, আমার অর্থমন্ত্রী থাকাকালীন সময়ে এত কম রাজস্ব আদায় ইতিপূর্বে হয়নি। এ ব্যর্থতার জন্য রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তাদের অভ্যন্তরীণ বিরোধ দায়ী হতে পারে। বিষয়টি নিয়ে তিনি মঙ্গলবারই এনবিআর চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলবেন বলে সাংবাদিকদের জানান।
জানা গেছে, চলতি অর্থবছরে ১ লাখ ৭৬ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের বিশাল লক্ষ্য রয়েছে। কিন্তু তা অর্জনে প্রথমেই হোঁচট খেল এনবিআর। প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) রাজস্ব আয়ে ঘাটতি ৫ হাজার ৮০৪ কোটি টাকা। এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে আমদানি শুল্ক, সম্পূরক শুল্ক, মূল্য সংযোজন কর (মূসক), আয়করসহ সব মিলিয়ে আদায় হয়েছে ৩০ হাজার ৯০৫ কোটি টাকা। এ সময়ে ৩৬ হাজার ৭০৯ কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ছিল এনবিআরের। অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকেই লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে এনবিআর।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ৩ মাসে আমদানি পর্যায়ে আমদানি শুল্ক, মূল্য সংযোজন কর, সম্পূরক শুল্ক, রফতানি শুল্ক আদায়ের পরিমাণ ৯ হাজার ৮৫৫ কোটি টাকা। এ খাতে ঘাটতি ১ হাজার ৩৬০ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই প্রান্তিকে এ খাতে আদায় হয়েছিল ৯ হাজার ১১২ কোটি টাকা।
স্থানীয় পর্যায়ে সাধারণত মূল্য সংযোজন কর, আবগারি শুল্ক, সম্পূরক শুল্ক ও টার্নওভার ট্যাক্স আদায় করা হয়। জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে এ খাতে রাজস্ব আদায় হয়েছে ১১ হাজার ৪৯৯ কোটি টাকা। এ খাতে ঘাটতি ২ হাজার ৪১৭ কোটি টাকা। গতবার একই সময়ে আদায় হয়েছিল ১০ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকা। আয়কর, ভ্রমণ করসহ প্রত্যক্ষ কর আদায়ে ঘাটতি হয়েছে ২ হাজার ২৬ কোটি টাকা। এ খাতে আদায় হয়েছে ৯ হাজার ৫৫১ কোটি টাকা।
রাশিয়ান ফেডারেশন ন্যাশনাল নিউক্লিয়ার কর্পোরেশন রোসাটোমের উপ-প্রধান নির্বাহীর সঙ্গে বৈঠকে তারা বাংলাদেশে দুই বিদেশী হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেছে কিনা জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী বলেন, এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়নি। তারা এসব বিষয়ে উদ্বিগ্নও নন। ইট ইস এ রিয়েল রাবিশ। এটা নিয়ে আপনারা (সাংবাদিকরা) উদ্বিগ্ন। বাংলাদেশের আইনশৃংখলা পরিস্থিতিতে কোনো ধরনের বিশৃংখলা নেই।
বিমানবন্দরে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারসহ সরকারের নিরাপত্তামূলক বিভিন্ন পদক্ষেপ জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী বলেন- ওয়েল, চারটা অ্যাম্বাসেডর এমন পরিস্থিতি তৈরি করেছেন যে, আপনাকে কিছু একটা করতেই হবে। অ্যান্ড দিস অ্যাম্বাসেডরস হ্যাভ ডান এ ডিস্টারব্যন্স ইন দিস কান্ট্রি।
একটি পত্রিকায় এসেছে, ইউএসএর একটি গোয়েন্দা সংস্থা বলেছে, যে ঘটনাগুলো ঘটেছে এবং সামনে আরও কিছু ঘটনা ঘটতে পারে, যে কারণে সরকার পতনসহ অর্থনৈতিক বিপর্যয় নেমে আসতে পারে বাংলাদেশে। এ ব্যাপারে অর্থমন্ত্রীর মন্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা নিয়ে আসলে কাকে কী বলব? এটা হচ্ছে, চার রাষ্ট্রদূতের বাজে কাজ। তারা খুবই বাজে কাজ করেছেন। তাদের নিজেদের দেশের ল অ্যান্ড অর্ডারের সঙ্গে বাংলাদেশের ল অ্যান্ড অর্ডারের তুলনা চলে না। আমাদের এখানে খুব ভালো অবস্থা। এরকম জনবহুল দেশে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম অত্যন্ত লো (কম)।
পুলিশ বলেছে, বিদেশীকে টার্গেট করে মারা হয়েছে। অর্থাৎ তারা বিদেশী মেরে দেশে অরাজকতা সৃষ্টি করতে চেয়েছে। তাই এটা আইনশৃংখলা পরিস্থিতির বিষয় না। এটা তো অন্য বিষয়। সাংবাদিকদের এমন কথার জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, আমাদের তদন্ত কার্যক্রম খুব ভালোভাবে এগোচ্ছে। বিদেশী নাগরিক হত্যা বৈদেশিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে কিনা জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী বলেন, কোনো প্রভাব পড়বে না।
বৈঠক প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী বলেন, রূপপুর পাওয়ার প্লান্ট নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। তারা নতুন দুটি পাওয়ার প্লান্ট স্থাপনের বিষয়ে আগামী মাসের মধ্যেই কন্ট্রাক্ট সাইন করতে চায়। এছাড়া ক্রেডিট অ্যাগ্রিমেন্টের বিষয়ে রাশিয়ার প্রতিনিধিরা আগামী বছরের এপ্রিলে কন্ট্রাক্ট সাইন করতে চায়। কিন্তু চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়ে আমাদের কিছু জটিলতা রয়েছে। আমরা সাধারণত চুক্তি স্বাক্ষরের আগে ক্রেডিট অ্যাগ্রিমেন্ট স্বাক্ষর করি। তারা বলেছে, চুক্তি স্বাক্ষর করলে তারা বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে যন্ত্রপাতিসহ আনুষঙ্গিক কাজ শুরু করতে পারবে। এটা করতেও অনেক সময় লাগবে। আমি তাদের বলেছি, বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করে তারপর জানাব। আগামী মাসে জানাব। তার আগে কিছু বলা যাচ্ছে না।
মন্ত্রী জানান, দুটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রথমটির কাজ শুরু হবে ২০১৭ সালে। এটা শেষ হবে ২০২২-২৩ সালে। দ্বিতীয়টির কাজ তার ২ বছরের মধ্যে, অর্থাৎ ২০২৪ এর মধ্যে শেষ হবে। তবে এটা আনুমানিক সাল। আমরা খোঁজ নিয়ে দেখেছি প্রথম বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি স্থাপন করতে ২০২৪ এবং দ্বিতীয়টির কাজ শেষ করতে ২০২৫ সাল পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।
অর্থমন্ত্রী বলেন, ২টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করতে রাশিয়া দেবে ১২ বিলিয়ন ডলার। আমরা প্রাথমিকভাবে ১২ বিলিয়নের ১০ শতাংশ অর্থ দেব। তাই সর্বসাকুল্যে দুটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে সাড়ে ১৩ বিলিয়ন ডলার লাগবে। ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট করে দুটি ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা হবে।
ক্রেডিটের টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশন সম্পর্কে কোনো ধারণা আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, সর্বমোট ২৮ বছরে আমাদের অর্থ ফেরত দিতে হবে। এর মধ্যে ১০ বছর হল গ্রস পিরিয়ড। অর্থাৎ ১৮ বছরের মধ্যে রাশিয়াকে অর্থ ফেরত দিতে হবে। সুদের সর্বোচ্চ হার হবে ৪ শতাংশ। দুটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে অবকাঠামো স্থাপন করতে ৮-৯ বছরের মতো সময় লাগবে। (যুগান্তর রিপোর্ট ২৮ অক্টোবর ২০১৫)

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর