জুয়া-ক্যাসিনো মোকাবিলায় বাংলাদেশের আইন কতটুকু পর্যাপ্ত

হাওর বার্তা ডেস্কঃ   বাংলাদেশে জুয়া খেলা রাষ্ট্রীয় আইনে নিষিদ্ধ। কারণ জুয়া একজন ব্যক্তির ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, আর্থিক ও নৈতিক সঙ্কট সৃষ্টি করে। বহুবিধ ক্ষতির সম্মুখীন ও অরাজকতা সৃষ্টি করে। এছাড়া ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আছে। সরকারের নিষেধাজ্ঞাকে অমান্য করে কিছু অসাধু ব্যক্তি জুয়ার আসর ক্যাসিনো জমিয়ে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। নিঃস্ব হয়েছেন অনেকে। আর খেলার স্থান হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে দেশের নামকরা জনপ্রিয় সব স্পোর্টস ক্লাবগুলোকে। লিখেছেন মো. রায়হানুল ওয়াজেদ চৌধুরী

ঢাকা-চট্টগ্রামে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বিত অভিযানে বেশ কয়েকটি স্পোর্টিং ক্লাবে পরিচালিত ‘ক্যাসিনো’ সিলগালা, বিশাল অঙ্কের নগদ টাকা, অস্ত্র ও স্বর্ণালঙ্কার উদ্বারসহ বহু মানুষকে আটকের পর জুয়াখেলা এবং ক্যাসিনো ইত্যাদি নিয়ে আলোচিত হচ্ছে দেশজুড়ে। বিভিন্ন সময়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় বা ক্লাবে বা আড্ডায় গোপনে জুয়াখেলার আসর বসা দেখা যায়। কিন্তু উন্নত বিশ্বের মতো জুয়াখেলার একেবারে আধুনিক সংস্করণ ডিজিটালাইজড যন্ত্রপাতি ও উপকরণ সজ্জিত এসব ক্যাসিনোগুলোর অস্তিত্ব আছে খবরে সাধারণ মানুষের কাছে বিস্ময় ও তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে।

সাধারণত বিত্তবানরা ক্যাসিনোতে মত্ত হন। আলোচিত জুয়া- ক্যাসিনো সম্পর্কে আমাদের দেশে যে আইনটি কার্যকর আছে সেটি ১৫২ বছরের বেশি পুরনো আইন যা ‘প্রকাশ্য জুয়া আইন, ১৮৬৭’। প্রকাশ্য জুয়া খেলা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে অপরাধে শাস্তি এবং সাধারণ ক্রীড়াভবনের ব্যবস্থা করার জন্য আইনটি প্রণয়ন করা হয়েছিল। যা মেট্রোপলিটন এলাকা ছাড়া সমগ্র বাংলাদেশে প্রযোজ্য হয়। কারণ মেট্রোপলিটন পুলিশ অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী জুয়াবিরোধী অভিযান পরিচালিত হয়।

দেশের সর্বোচ্চ আইন বাংলাদেশ সংবিধানের ১৮ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘গণিকাবৃত্তি ও জুয়াখেলা নিরোধের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে’। পরে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের বিভিন্ন মামলায় প্রদত্ত রায়েও জুয়া নিষিদ্ধ করার কথা বলা হয়েছে। ২০১৩ সালে হাইকোর্টে বিভাগের একটি বেঞ্চ জুয়াখেলার অনুমতি চেয়ে করা একটি রিট খারিজ করে রায় দেয় দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে জুয়া খেলা দন্ডনীয় অপরাধ।

এই আইনে বলা হয়েছে, ‘জুয়া’ খেলা শব্দ দ্বারা জুয়া বা বাজি ধরা বোঝাবে। ‘ক্রীড়াসামগ্রী’ শব্দ দ্বারা জুয়া খেলার কাজে ব্যবহৃত যে কোনো হাতিয়ার বা সামগ্রীকে বোঝাবে। এবং যে কোনো ঘর, স্থান তাঁবু জুয়ার আসর হিসেবে ব্যবহৃত হলে তার মালিক বা রক্ষণাবেক্ষণকারী, জুয়ার ব্যবস্থাপক বা এতে কোনো সাহায্যকারী অপরাধী হিসেবে দোষী সাব্যস্ত হবে।

আইনের ৩ ধারায় বলা হয়েছে, সাধারণ জুয়ার স্থান হিসেবে যে কোনো ঘর, তাঁবু, কক্ষ, প্রাঙ্গণ বা প্রাচীরবেষ্টিত স্থানের মালিক বা রক্ষণাবেক্ষণকারী ব্যবহারকারী হিসেবে মুনাফা বা উপার্জনের জন্য ভাড়া দিলে অপরাধী হবেন। আরও বলা হয়েছে, যে কোনো ক্রীড়াসামগ্রী বা অন্যকিছু ভাড়া বা অর্থের বিনিময়ে রাখা বা ব্যবহার করতে দিলেও অপরাধী হবে। এ ছাড়া উলিস্নখিত স্থানের মালিক বা রক্ষণাবেক্ষণকারী হিসেবে যে কোনো ব্যক্তি জ্ঞাতসারে বা স্বেচ্ছায় অন্য লোককে উক্ত স্থানকে সাধারণ জুয়ার স্থান হিসেবে ব্যবহার করতে দিলেও অপরাধী হবে।

কেউ উপরে বর্ণিত স্থানকে উক্ত উদ্দেশ্যে ব্যবহারের কাজে ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব পালন করলে অথবা যে কোনোভাবে সহায়তা করলে অনুরূপ স্থানে কেউ জুয়া খেলার উদ্দেশ্যে অর্থ প্রদান করলে বা খাটালেও অপরাধী হিসেবে গণ্য হবে।

উপরে বর্ণিত অপরাধের শাস্তি হিসেবে ৩ মাসের কারাদন্ড বা অনূর্ধ্ব ২০০ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হতে পারে। আইনের ৪ ধারায় বলা হয়েছে কোনো ঘরে, কক্ষে, তাঁবুতে, প্রাঙ্গণে বা প্রাচীরবেষ্টিত স্থানে তাস, পাশা, কাউন্টার অর্থ বা অন্য যে কোনো সরঞ্জামসহ যে কোনো ব্যক্তিকে ক্রীড়ারত বা বিপরীত প্রমাণিত না হলে কোনো লোক উপস্থিত দেখতে পাওয়া গেলে তিনিও অপরাধী হবেন। যার শাস্তি হিসেবে ১ মাস পর্যন্ত কারাদন্ড বা ১০০ টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হতে পারেন।

আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী যে কোনো সময় জুয়ার স্থানে প্রবেশ করতে পারবে। এই আইনের ৫ ধারায় বলা হয়েছে, ‘ম্যাজিস্ট্রেটের পূর্ণ ক্ষমতাসম্পন্ন যে কোনো অফিসার অথবা পুলিশ সুপারিন্টেন্ডেট নির্ভরযোগ্য সংবাদ পাইয়া এবং প্রয়োজন মনে করিলে যথোচিত তলস্নাশি চালাইয়া যদি মনে করেন যে, অনুরূপ ঘর, তাঁবু, কক্ষ, প্রাঙ্গণ বা প্রাচীরবেষ্টিত স্থানে সাধারণ ক্রীড়া ভবন হিসেবে ব্যবহৃত হইয়া থাকে, সেই স্থানে প্রয়োজনীয় সাহায্যকারীসহ দিনে বা রাত্রে যে কোনো সময় (প্রয়োজন হইলে শক্তি প্রয়োগ করে) প্রবেশ করিতে এবং ওই সময় ওই স্থান ক্রীড়ারত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করিতে পারিবে এবং জুয়া খেলার কাজে ব্যবহৃত সরঞ্জাম, অর্থ ও অন্যান্য সামগ্রী আটক করিতে পারিবে। এ ছাড়া জুয়া খেলার কোনো সামগ্রী লুক্কায়িত রহিয়াছে বলিয়া সন্দেহ হইলে জুয়ার স্থানের যে কোনো অংশে এবং আটককৃত যে কোনো ব্যক্তির দেহ তলস্নাশি চালাইতে পারিবেন; এবং অনুরূপ তলস্নাশি দ্বারা প্রাপ্ত জুয়া খেলার যে কোনো সামগ্রী আটক করিতে পারিবেন।’

সন্দেহজনক গৃহে তাস পাওয়া মানেই ওই গৃহ সাধারণ জুয়ার আখড়া-এমন ব্যাখ্যা পাওয়া যায় এ আইনে। ৬ ধারায় বলা হয়েছে, ‘যখন তলস্নাশিকৃত কোনো স্থানে কোনো তাস, পাশা, খেলার টেবিল, বোর্ড বা অন্যান্য জুয়ার সামগ্রী পাওয়া যাবে অথবা তলস্নাশির সময় আটককৃত ব্যক্তিদের দেহ তলস্নাশি করে অনুরূপ কোনো সামগ্রী পাওয়া যাইবে তখন বিপরীত প্রমাণিত না হইলে ওই সামগ্রীই প্রমাণ করবে যে, সংশ্লিষ্ট গৃহ, তাঁবু, কক্ষ, প্রাঙ্গণ বা প্রাচীরবেষ্টিত স্থান জুয়ার আখড়া হিসেবে ব্যবহৃত হয় এবং ম্যাজিস্ট্রেট বা পুলিশ অফিসার স্বচক্ষে খেলিতে না দেখিলেও তলস্নাশিকালে ওই স্থানে যাহারা উপস্থিত ছিল তাহারা সকলেই জুয়া খেলার উদ্দেশ্যে সেখানে অবস্থান করিতেছিল বলিয়া গণ্য হইবে।’

৮ ধারা অনুযায়ী, ‘জুয়ার স্থানে প্রাপ্ত যাবতীয় জুয়ার সামগ্রী ধ্বংস করতে পারিবে এবং ওই স্থানে প্রাপ্ত যে কোনো অর্থ বা জামানতের টাকা বা অন্যান্য ক্রীড়াসামগ্রী বাজেয়াপ্ত করিবার বা ক্রীড়াসামগ্রী বিক্রয় করিয়া অর্থ সংগ্রহের জন্য নির্দেশ দিতে পারিবে’।

১৩ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি এই আইনে একবার দন্ডিত হইবার পর পুনরায় এই আইনের অধীনে অপরাধ করিলে তজ্জন্য তাহার দন্ডের পরিমাণ দ্বিগুণ হইবে : শর্ত থাকে যে, অনুরূপ ব্যক্তি অভিযুক্ত হইয়া ছয়শত টাকার অধিক জরিমানায় অথবা ১ বছরের অধিককালের জন্য কারাদন্ডে দন্ডিত হইবে না।

‘প্রকাশ্য জুয়া আইন ১৮৬৭’ কার্যকর থাকা সত্ত্বেও চলমান অভিযানে ঢাকা ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন ক্লাবে ক্যাসিনো সিলগালা ও অনেকেই আটক হয়েছেন। কিন্তু তাদের কারও বিরুদ্ধেই ‘জুয়া আইনে’ মামলা হয়নি। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, মানি লন্ডারিং আইন এবং অস্ত্র আইনে সব মামলা হয়েছে।

এখানে উলেস্নখ্য, আমাদের দেশে সরকারের কাছ থেকে লাইসেন্স বা পারমিট নিয়ে মদ বিক্রি ও পানের সুযোগ আছে। কিন্তু মদ বিক্রি বা পানের মতো ক্যাসিনোর অনুমোদন বা লাইসেন্স দেয়ার কোনো ব্যবস্থা বা সুযোগই বাংলাদেশের কোনো আইনে নেই। কারণ এটা হবে সুস্পষ্ট সংবিধানবিরোধী। ্র

ক্যাসিনো বা জুয়া খেলার ১৫২ বছরের দুর্বল আইন সংশোধন করে যুগোপযোগী কঠোর আইন করা সময়ের দাবি।

লেখক : কলামিস্ট ও আইনজীবী, জজ কোর্ট, চট্টগ্রাম।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর