নেপথ্যে লাভলু তিন ভাইয়ের অপরাধ সাম্রাজ্য

রাজধানীর ওয়ান্ডারার্স ক্লাব ক্যাসিনো কেলেঙ্কারিতে এখন আলোচনায় একটি পরিবার। তিন ভাই, দুই ভাতিজাসহ আলোচিত ওই পরিবারের ১৭ জন আওয়ামী লীগের স্থানীয় পর্যায়ের বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করছেন। জুয়ার টাকায় করেছেন ১৫ বাড়ি। এই পরিবারটি ওয়ারী থানা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি রশিদুল হক রশিদ ভূঁইয়ার। পুরান ঢাকার মূর্তিমান আতঙ্ক রশিদ, এনু ও রুপন এই তিন ভাই। পরিবারের ১৭ জন আওয়ামী লীগের স্থানীয় পর্যায়ের বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করছেন। তারা হচ্ছেন, ওয়ারী
থানা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি রশিদুল হক ভূঁইয়া , গেন্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি এনামুল হক ভূঁইয়া এনু ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রূপন ভূঁইয়া ।

আরেক ভাতিজা তানিম হক ৪১ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও বাতেনুর হক বাঁধন (রশিদের ছেলে) ৪১ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক।

এ ছাড়া এই পরিবারের সদস্য যারা ওয়ান্ডারার্স ক্লাব ও নারিন্দা জুনিয়র ক্লাবের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন তারা হলেন, পাভেল রহমান ৪০ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি (ম্যানেজার ওয়ান্ডারার্স ক্লাব), মো. আসলাম ৪০ নং ওয়ার্ডের ক্রীড়া সম্পাদক, জাহাঙ্গীর আবদুল্লাহ ৪০ নং ওয়ার্ডের যুগ্ম সম্পাদক, মো. রাজ্জাক ৪০ নং ওয়ার্ডের বন ও পরিবেশ সম্পাদক, মো. হারুন ৪০ নং ওয়ার্ড কমিটির ২২ নং নির্বাহী সদস্য, আফতাব উদ্দিন আফতাব ৪১ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক, মো. তারেক ৪১ নং ওয়ার্ডের কৃষিবিষয়ক সম্পাদক, মো. রতন ৪১ নং ওয়ার্ডের ধর্মবিষয়ক সম্পাদক, মনজুরুল কাদের মামুন ৪১ নং ওয়ার্ড কমিটির সাংস্কৃতিক সম্পাদক, মিজানুর রহমান মিজান ৪১ নং ওয়ার্ড কমিটির যুব ও ক্রীড়া সম্পাদক, মো. মঞ্জু ৪১ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সদস্য, কুতুবউদ্দীন ৪১ নং ওয়ার্ড সদস্য, আসাদউল্লাহ আসাদ ৪০ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি। সারোয়ার হাসান আলো ৪১ নং ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক ও কাউন্সিলর, শহীদুল্লাহ মিনু গেন্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি।

এদের মধ্যে ওয়ারী থানা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি রশিদুল হক রশিদ ভূঁইয়ার আধিপত্য সবচেয়ে বেশী হলেও এখন তিনি রয়েছেন লাপাত্তা। ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের জুয়া-ক্যাসিনো থেকে আয়ের কোটি কোটি টাকা দিয়েই এ সম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন তিনি। নিজের এলাকাতেই গড়ে তুলেছেন কয়েকটি ক্লাব। এখানেও জুয়া খেলা হয় বলে অভিযোগ উঠেছে। শুধু ক্যাসিনো পরিচালনার সঙ্গেই যুক্ত নয়, এই পরিবারটি এলাকার অপরাধজগত নিয়ন্ত্রণ করতো বলে অভিযোগ রয়েছে। জোর করে ভয় দেখিয়ে নাম মাত্র মূল্যে জমি লিখে নেয়ার অভিযোগও আছে তার ভাইদের বিরুদ্ধে। তারা এলাকায় ক্যাডার দিয়ে গড়ে তুলেছেন নিজস্ব বাহিনী। নিয়মিতভাবে এলাকায় গাড়ির হর্ণ বাজিয়ে মহড়া দেয় বাহিনীর সদস্যরা। এসব কারণে কেউ তাদের সামনে দাঁড়ানোর সাহস পায়নি।

অনুসন্ধানে জানা যায়, সমালোচিত এই ভূঁইয়া পরিবারকে নেপথ্যে থেকে শেল্টার দিতেন প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা ওয়ারী থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি চৌধুরী আশিকুর রহমান লাভলু। ক্যাসিনোর অবৈধ টাকার বিনিময়ে রশিদকে পদ পাইয়ে দেয়া থেকে শুরু করে সকল অপকর্ম শেল্টার দিতেন এই লাভলু। অভিযোগ রয়েছে, কাপ্তান বাজারে মরা মুরগী বিক্রির অসাধু চক্রের হোতা তিনি। এই চক্রটি কেবল ঢাকায় নয়, এর আশপাশেও মরা মুরগি সরবরাহ করেছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। এতে নিরাপদ খাদ্যের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন ভোক্তারা। গত আট বছর ধরে এই মরা মুরগির ব্যবসা করলেও এ নিয়ে তাদের সামনে কথা বলার সাহস পায়নি কেউ। এলাকায় বিষয়টি প্রায় ওপেন সিক্রেট। কাপ্তার বাজারের এক ব্যবসায়ী বলেন, দীর্ঘদিন ধরে তিনি মরামুরগির ব্যবসা করলেও বিষয়টি নিয়ে তার সঙ্গে কেউ কথা বলার সাহস পায়নি। তিনি যখন এলাকায় আসেন দলবল নিয়ে আসেন । আমাদের মতো ছোট ব্যবসায়ীরা তার সাথে কথা বলতে পারা স্বপ্নের মতো।

শুধু মরামুরগি নিয়ে ক্ষান্ত নন এই নেতা। তার এই সিন্ডিকেট মানহীন ক্যাবলে ভালো কোম্পানির লোগো লাগিয়ে বাজারজাত করার অভিযোগও আছে তার বিরুদ্ধে। এসব অবৈধ ব্যবসা করে যেমনটা ঠকাচ্ছে সাধারন মানুষদের তেমনি তিনি হাতিয়ে নিয়ে যাচ্ছে হাজার কোটি টাকা।

অভিযোগ রয়েছে, প্রভাবশালী এই আওয়ামী লীগ নেতার মালয়েশিয়া এবং সিঙ্গাপুরে রয়েছে সেকেন্ড হোম। তার ভাই খোকন থাকেন লন্ডনে। সেখানেও টাকা পাচার করে ভাইয়ের নামে বাড়ি করেছেন বলে জানা গেছে। কথিত আছে, লাভলুর ঘনিষ্ঠ ওয়ারী থানা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মামুনুল হাসান পলাশ এখন হাজার কোটি টাকার মালিক। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরে কানা বাবু, লোটন, মোশারফ বাবু, বাবলা এদের মাধ্যমে অপরাধ সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করেন তিনি।

পরে সন্ত্রাসীদের গুলিতে কানাবাবু এবং লোটন মারা গেলেও লাভলুর অপরাধ সিন্ডিকেট থেমে থাকেনি। মাদক, চাঁদাবাজি, দখলবাজি সবই করে এই সিন্ডিকেট। পরিবহন সেক্টর থেকে চাঁদাবাজির অভিযোগ রয়েছে। কাপ্তান বাজারের মুরগী পট্টি, এরশাদ মার্কেটে অবৈধভাবে দোকান দখলের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। একসময় ফাঁসির আসামি হিসেবে পলাতক ছিলেন লাভলু। ১৯৯৬ সালে তিনি দেশে ফিরে আসেন। এলাকায় একসময় তিনি বিতর্কিত নেতা আওরঙ্গের ক্যাডার হিসেবে পরিচিত ছিলেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তার কমিটির একজন ছাত্রলীগ নেতা ক্ষোভের সুরে বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে লাভলু দেশে আসে। দল ক্ষমতায় না থাকলে তাকে আর এলাকায় দেখা যায় না। এজন্য এলাকার অনেকেই তাকে সুসময়ের পাখি বলে ডাকে। পুরান ঢাকার নারিন্দা লায়ন্স ক্লাবে ক্যাসিনো চালানোর জন্য রশিদকে ক্লাবটি দখল করে দিয়েছিলেন লাভলু। সে সময় স্থানীয় মসজিদ কমিটির বাধাও মানেননি তিনি। শুধু তাই নয়, ওয়ারিতে একটি হেরিটেজ স্কুল ভেঙ্গে মার্কেট করার অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে।

এলাকাবাসী জানায়, লাভলুকে আটক করলেই ক্যাসিনো বাদশা রশিদের খোঁজ পাওয়া যাবে। এদিকে, এলাকাবাসী বলছে ক্যাসিনো অভিযানের পর লাভলু বেশ কয়েকদিন ধরে গা ঢাকা দিয়ে আছেন। আগের মতো এলকায় নেই তার শো ডাউন। তার সঙ্গের নেতাকর্মীদেরও এখন দেখা যায় না।

ওয়ারী থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি চৌধুরী আশিকুর রহমান লাভলু বলেন, রশিদুল হক রশিদ ভূঁইয়া দীর্ঘদিন ৪১ নাম্বার ওয়ার্ড আওয়ামীলীগের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। আমরা যখন থানা কমিটি করেছি তখন তার নাম যখন লিস্টে আসছে তখন থেকেই তাকে আমি চিনি। এর আগে মিছিল মিটিংয়ে তাকে আমি দেখেছি। তার সাথে আমার কোনো ধরনের যোগাযোগ নেই। এটা সম্পূর্ন একটা মিথ্যা এবং ভিত্তিহীন কথা। ক্যাবল এবং মরা মুরগির ব্যবসা নিয়ে তিনি বলেন, আমি জীবনেও ক্যাবল বা এসব ব্যবসা করিনি। আমি অটোপার্সের ব্যবসা করি। আমি বাংলাদেশ অটোপার্স ব্যবসায়ী এসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট। আবেদ ও জাবেদকে নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, তারা তো নওয়াবপুরে ব্যবসা করে । ওরা তো ক্রিমিনাল। ওদের বিষয়ে যারা নওয়াবপুরে ইলেকট্রনিকস ব্যবসা করে তারা বলতে পারবে।

৩৮ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোশারফ হোসেনকে নিয়ে তিনি বলেন , সে তো দীর্ঘ বারো বছর এই ওয়ার্ডের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলো। তার আগে সমাজকল্যান সম্পাদক ছিলো পনেরো বছর। সে বাসিন্দা হয় না কিভাবে? এখান প্রতিষ্ঠালগ্নের প্রেসিডেন্ট ছিলেন হাবিব ভাই। তখন থেকেই সে সমাজকল্যান সম্পাদক ছিলো। তিনি বলেন, এসব রাজনৈতিক কারণে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ আসে। রাজনীতি করলে এ ধরনের অভিযোগ আসেই। একটা মানুষ রাজনীতি করে দীর্ঘদিন একটা ক্যারেক্টার দাড় করাতে হয়। আমি ছাত্রলীগ করেছি ,যুবলীগ করেছি,আওয়ামীলীগ করেছি। আমি তো আর হুট করে আসিনি। কেউ যদি অভিযোগ করতে পারে আমি চাঁদাবাজি করেছি, তাহলে আমি রাজনীতি ছেড়ে দিবো। একটা দল করতে গেলে সবাইকে সন্তুষ্ট করা সম্ভব হয় না। হয়তো কেউ অসন্তুষ্ট হয়ে এধরনের অভিযোগ করেছে আমাকে নিয়ে। আমার ভাই তো লন্ডনে থাকে মাত্র দুইবছর হলো কাগজপত্র হয়েছে। তার মেয়ের জন্ম হয়েছে সেখানে। সেখানকারই সিটিজেন। এগুলো যারা বলছে, জঘন্য কথাবার্তা বলছে। এটা হতে পারে না। আমার ছোট ভাই দীর্ঘদিন কষ্টে ছিলো। এখন ওরা ভালো আছে। আমার এলাকায় যদি দুই টাকার চাদাঁবাজির অভিযোগ দেখাতে পারে কেউ, তাহলে আমি রাজনীতি ছেড়ে দেশ থেকে চলে যাবো।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর