সাহাবায়ে কেরামের কাব্যচর্চা

হাওর বার্তাঃ রাসুল (সা.) জন্মগ্রহণ করেছিলেন কবি ও কবিতার জন্য প্রখ্যাত এক জনপদে। তাঁর মা আমিনা ছিলেন যুগধর্মের দাবিতে একজন স্বভাব কবি। রাসুল (সা.) এর বাবা আবদুল্লাহ ইবনে আবদুল মুত্তালিবের আকস্মিক মৃত্যুর পর তিনি যে শোকগাথা গেয়ে রোনাজারি করেছিলেন, তা ইতিহাসখ্যাত। রাসুল (সা.) এর জন্মের আগে মা আমিনা জগৎখ্যাত এক শিশুর জন্মের বিষয়ে প্রায়ই স্বপ্নাদিষ্ট হতেন। এ ভাবাবেগেও তিনি বেশকিছু খ- কবিতা রচনা করেন। তাঁর পিতৃব্য আবু তালিবেরও কবিখ্যাতি ছিল সুবিদিত। অর্থাৎ তার জন্ম হয়েছিল এক কবি পরিবারে।
শরিদ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন একদিন আমি রাসুল (সা.) এর সঙ্গে কোনো বাহনের পিঠে সওয়ার ছিলাম। এমন সময় তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন উমাইয়া ইবনে আবি সালতের কোনো কবিতা কি তোমার মনে আছে? রাসুল (সা.) এর প্রশ্নের জবাবে শরিদ (রা.) জবাব দেন, হ্যাঁ মনে আছে। তিনি বললেন, পড়ো। আমি একটি কবিতা পড়ে থামলে তিনি বলেন, আরও পড়ো। এভাবে আমি তার একশটি কবিতা পড়লাম।
রাসুল (সা.) একবার মরুপথে উটের পিঠে দীর্ঘ সফরে বের হয়েছেন। রাতও হয়েছে বেশ। সাহাবিদের বললেন হাসসান কোথায়? হাসসান (রা.) এগিয়ে এলেন। বললেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ এই তো আমি। মহানবী (সা.) বললেন আমাদের কিছু ‘হুদা’ শুনাও তো। শুরু করলেন কবি। কবিতা শুনতে শুনতে মহানবী (সা.) মন্তব্য করলেন, কবিতাকে এজন্যই বলা হয় বিদ্যুতের চেয়ে দ্রুতগতি সম্পন্ন এবং এর আঘাত শেলের আঘাতের চেয়েও ক্ষিপ্র ও ভয়ানক। আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেছেন, মহানবী (সা.) বললেন তোমরা কাফের-মোশরেকদের নিন্দা করে কাব্য লড়াইয়ে নেমে পড়। তীরের ফলার চেয়ে তা আরও বেশি আহত করবে তাদের। অন্য হাদিসে এসেছে ‘যারা হাতিয়ারের দ্বারা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের সাহায্য করে, কথার দ্বারা (অর্থাৎ কবিতার দ্বারা) আল্লাহর সাহায্য করতে কে তাদের বাধা দিয়েছে?
মুহাম্মদ ইবনে সিরিন (রহ.) বলেন, রাসুলের নির্দেশ পেয়েই তিনজন ইসলামি কবি হাসসান বিন সাবিত, কাব বিন মালিক এবং আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহ কাফিরদের বিরুদ্ধে কবিতার লড়াইয়ে নেমে পড়েন। হাদিসের বর্ণনা থেকে আরও জানা যায়, মহানবী (সা.) আনসারিদের সমবেত করে উচ্ছ্বসিত আবেগে বললেন, এ তো অনস্বীকার্য, আল্লাহর রাসুলকে হেফাজত করার জন্য অস্ত্র হাতে নিয়ে তোমরা অতন্দ্র প্রহরী হয়ে কাজ করছ, কলমের ভাষা দিয়ে তাকে আজ হেফাজত করার সময় এসে গেছে। কে আছ তীক্ষ মসীর আঁচড় নিয়ে এগিয়ে আসবে?
কাব ইবনে মালেক বলেন রাসুল (সা.) আমাদের নির্দেশ দিলেন, যাও, তোমরা মোশরেকদের প্রতিপক্ষে কবিতার লড়াইয়ে লেগে যাও। কারণ মোমিন জিহাদ করে জান দিয়ে ও মাল দিয়ে। মুহাম্মদের আত্মা যার হাতে তাঁর শপথ! তোমাদের কবিতা, তীরের ফলা হয়ে তাদের কলিজা ঝাঁজরা করে দেবে।
কবি সুহাইমের একটি কবিতা শুনে মহানবী (সা.) বললেন বেশ তো! ঠিক কথাই বলেছে কবি। এ ধরনের কথায় আল্লাহ তায়ালা খুশি হন। আর যাকে আল্লাহ সোজা পথে রেখেছেন এবং নৈকট্য দিয়েছেন সে জান্নাত পাবে।
রাসুল (সা.) নিজে সাহিত্যপ্রেমিক ছিলেন এবং কবিতা শুনতে ভালোবাসতেন এতটুকুতেই তাঁর কাব্যপ্রেম সীমাবদ্ধ ছিল না। অন্যদেরও তিনি কবিতার প্রতি আগ্রহী করে তুলতে সচেষ্ট ছিলেন। তিনি বলেছেন ‘নিঃসন্দেহে কোনো কোনো কবিতায় রয়েছে প্রকৃত জ্ঞানের কথা।’ রাসুল (সা.) এর এ উৎসাহের কারণেই তাঁর ঘনিষ্ঠ সাহাবি, যাদের কাব্যচর্চার যোগ্যতা ছিল তারা প্রায় সবাই কাব্যচর্চা করতেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন হাসসান বিন সাবিত, লবিদ বিন রাবিয়াহ, কাব ইবনে জোহায়র, আবদুল্লাহ বিন রাওয়াহা, কাব বিন মালিক, জুহায়র বিন জুনাব, আব্বাস বিন মিরদাস, সুহায়ম, আননাবিগা ওরফে আবু লায়লা (রা.) প্রমুখ। মহিলা কবিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন নবী কন্যা ফাতেমাতুজ জোহরা ও খানসা (রা.) প্রমুখ। এমনকি খোলাফায়ে রাশেদিনের মধ্যে ওসমান (রা.) ব্যতীত বাকি তিনজনই তৎকালীন আরবের প্রসিদ্ধ কবি হিসেবে খ্যাতিমান ছিলেন।
তৎকালীন আরবে তখনও গদ্য সাহিত্যের উদ্ভব হয়নি; তাই কবিতাই ছিল সাহিত্যের একমাত্র বাহন। স্বাভাবিকভাবেই কাব্যচর্চায় উৎসাহ দেওয়া মানে সাহিত্যচর্চার জন্য অনুপ্রাণিত করা। এসব ঘটনা প্রমাণ করে রাসুল (সা.) কাব্যকলাকে শিল্পকলার সীমাবদ্ধ গ-ি থেকে বের করে জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করেছিলেন, হাতিয়ারে পরিণত করেছিলেন যুদ্ধ ও জিহাদের। আর এভাবেই তাঁর নেতৃত্বে নব উত্থিত সমাজ বিপ্লবে সাহাবি কবিদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে তাদের মধ্যে এক নব উদ্দীপনার সৃষ্টি করেছিলেন মহানবী (সা.)। রাসুল (সা.) শুধু কবি ও কবিতার পৃষ্ঠপোষকই ছিলেন না, তিনি কবি ও কবিতাকে উৎসাহিত করার জন্য বিভিন্ন সময় কবিতার ওপর আলোকপাত করেছেন, মন্তব্য রেখেছেন। মহানবী (সা.) অনেককেই জীবিতাবস্থায় জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছিলেন। কবিতা লেখার পুরস্কার হিসেবে জান্নাতের সুসংবাদ পেয়েছিলেন হাসসান বিন সাবিত (রা.)। হাসসান বিন সাবিতের কবিতা শুনে রাসুল (সা.) ঘোষণা দিয়েছিলেনহে হাসসান, আল্লাহর কাছ থেকে তোমার জন্য পুরস্কার রয়েছে জান্নাত।
আজ যারা ইসলামি সাহিত্যচর্চা করছেন তাদের এ কথা গভীরভাবে স্মরণ রাখা দরকার, সাহিত্যচর্চা কোনো তুচ্ছ কাজ নয়, বরং সভ্যতা বিনির্মাণের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ আল্লাহ তাদের ওপর ন্যস্ত করেছেন। আর আল্লাহ তায়ালা কবিদের সম্মানার্থে পবিত্র কোরআনের একটি সূরার নাম করেছেন আশশোয়ারা বা কবিরা। মহানবীই (সা.) আমাদের আদর্শ। তিনি যা করেছেন, করতে বলেছেন বা করার সম্মতি দিয়েছেন তাই সুন্নাহ।
সাহিত্যের ব্যাপারেও একই কথা। আমরা যারা আজ কাব্যচর্চা করছি, রাসুলের এসব কথা ও নির্দেশই আমাদের পথপ্রদর্শক। কবি ও কবিতাকে ভালোবাসার এবং পৃষ্ঠপোষকতা করার যে সুন্নত তিনি রেখে গেছেন আসুন আমরা তার অনুসরণ করি।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর