আওয়ামী লীগের শুদ্ধি অভিযান প্রসঙ্গে

হাওর বার্তাঃ বাংলাদেশে অপরাধের জগৎ সম্পর্কে ভূরি ভূরি তথ্য এখন দৈনিক সংবাদপত্রের পাতায় কয়েক দিন ধরে প্রকাশিত হচ্ছে। এই জগৎ সমাজের সর্বস্তরে, সর্বত্র বিস্তৃত। প্রশাসন, পুলিশ, রাজনৈতিক দল ও তাদের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠন, আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ ইত্যাদি সংগঠন, শিল্প-ব্যবসা-ব্যাংকিং থেকে নিয়ে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত অপরাধের জগৎ এখন বিস্তৃত। এককথায় বলা চলে, বাংলাদেশ এখন অপরাধীদের এক ভূস্বর্গে পরিণত হয়েছে। তাদের থাবার বাইরে কোনো ক্ষেত্রই আর নেই।

গত ২১ সেপ্টেম্বর যুগান্তরের প্রথম পৃষ্ঠা থেকে নিয়ে ভেতরের পৃষ্ঠা পর্যন্ত অপরাধ জগতের সংবাদে ভরপুর। এ সম্পর্কিত রিপোর্টের শিরোনামগুলো হল : ‘জি কে শামীম সাবেক এক মন্ত্রীকে ঘুষের টাকা দিতেন বস্তাভরে’, ‘যুবলীগের শামীম গ্রেফতার’, ‘সম্রাট এখন কোথায়?’, ‘কলাবাগান ক্রীড়াচক্রের সভাপতি অস্ত্র ইয়াবাসহ গ্রেফতার’, ‘অপকর্মে জড়িত আ’লীগ নেতাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা’, ‘এবার অভিযান নদী ও বনখেকোদের বিরুদ্ধে’, ‘র‌্যাবকেও ম্যানেজ করতে চেয়েছিলেন খালেদ’ ইত্যাদি। শুধু প্রথম পৃষ্ঠারই সংবাদ এগুলো। নিঃসন্দেহে এটা এক ভয়াবহ ব্যাপার। স্বাধীন বাংলাদেশ স্বাধীনতার ৪৮ বছর পর এখন এই ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি।

আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন যুবলীগের উচ্চতম পর্যায় থেকে নিুস্তর পর্যন্ত নেতাদের ক্রিমিনাল তৎপরতার বিরুদ্ধে সরকারের অভিযান সম্পর্কিত রিপোর্ট প্রকাশিত হতে থাকার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের অপরাধ জগতের চিত্র এখন এ দেশের জনগণের চোখের সামনে। বাংলাদেশে অপরাধের জগৎ যে সর্বত্র বিস্তৃত এ কথা জনগণের কাছে নতুন নয়। দীর্ঘদিন থেকে তারা এ বিষয়ে বিভিন্ন সূত্র থেকে এবং নিজেদের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে জেনে এসেছেন। এখন সরকারিভাবে এ অবস্থা স্বীকৃত হল।

বাংলাদেশে এখন যুবলীগের অপরাধীদের তৎপরতার বিষয় প্রকাশিত হয়েছে তাদের ক্যাসিনো বাণিজ্যের তথ্য সম্পর্কিত নানা রিপোর্টের মাধ্যমে। ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯ তারিখের যুগান্তরের এক রিপোর্টে বলা হয়, ‘শাহজাহানপুর রেলওয়ে কলোনিতে বেড়ে ওঠা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া ফকিরাপুলের ইয়ংমেন্স ক্লাবের সভাপতি। স্থানীয় ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ওই ক্লাবটি এক সময় ফুটবল খেলার জন্য বিখ্যাত ছিল।

খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে নানা ধরনের অপকর্ম শুরু হয়। বসে জুয়ার আসর। তরুণ-তরুণীদের আনাগোনা চলে গভীর রাত পর্যন্ত। জুয়ায় সর্বস্বান্ত হয়ে অনেককে হাহাকার করতে দেখা গেছে বলে জানান প্রত্যক্ষদর্শীরা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শনিবার আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় ছাত্রলীগ, যুবলীগ নেতাদের নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নয়ন প্রকল্পে চাঁদা দাবির অভিযোগে সমালোচনার মুখে থাকা রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও গোলাম রাব্বানীকে ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়।

যুবলীগের কয়েক নেতা সম্পর্কেও ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এরপর বুধবার রাতে আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনটির প্রভাবশালী নেতা খালেদকে গ্রেফতার করল র‌্যাব। বৈঠকে উপস্থিত আওয়ামী লীগের একাধিক নেতার ভাষ্য, প্রধানমন্ত্রী যুবলীগের কয়েকজন নেতাকে নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, তারা শোভন-রাব্বানীর চেয়েও খারাপ। প্রধানমন্ত্রী বলেন, যুবলীগের ঢাকা মহানগরের একজন নেতা যা ইচ্ছা করে বেড়াচ্ছে, চাঁদাবাজি করছে। আরেকজন এখন দিনের বেলায় প্রকাশ্যে অস্ত্র উঁচিয়ে চলেন। সদলবলে অস্ত্র নিয়ে ঘোরেন।

এসব বন্ধ করতে হবে। যারা অস্ত্রবাজি করেন, যারা ক্যাডার পোষেন, তারা সাবধান হয়ে যান, এসব বন্ধ করুন। তা না হলে যেভাবে জঙ্গি দমন করা হয়েছে, একইভাবে তাদেরও দমন করা হবে। যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট এবং সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রী ওইসব কথা বলেছিলেন বলে জানান অনেক নেতা।’

বুধবার রাতে র‌্যাব ইয়ংমেন্স ক্লাবে অভিযান চালায়। অভিযান শেষে ঘটনাস্থলে এক সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম বলেন, রাজধানীর বুকে অবিশ্বাস্যভাবে ক্যাসিনো চলছিল। আর ক্যাসিনোর আড়ালে এখানে চলত মাদক ব্যবসা।

পরিস্থিতি কত সংকটজনক এবং দুর্নীতি ও ক্যাসিনোতে জুয়ার আড্ডা কতদূর বিস্তৃত এবং এর সঙ্গে অবিশ্বাস্যভাবে কারা জড়িত এ প্রসঙ্গে রিপোর্টে বলা হয়, ‘রাজধানীর ফকিরাপুলে ইয়ংমেন্স ক্লাবের গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান ঢাকা-৮ আসনের সংসদ সদস্য রাশেদ খান মেনন। তিনি দাবি করেছেন, ক্লাবের ভেতরে জুয়ার আড্ডা বসত এমন খবর তার কাছে ছিল না। তিনি ক্লাবটিকে ফুটবল ও ক্রিকেট খেলার ক্লাব হিসেবেই জানতেন।’

এটাও এক তাজ্জব ব্যাপার! ক্লাবটিতে জুয়ার আড্ডা এবং মদের ব্যবসা চলা সত্ত্বেও মেননের মতো একজন ব্যক্তি তার কোনো খবরই রাখতেন না, এটা এক বিস্ময়কর ব্যাপার। তার অবস্থা শুনে মনে হয় তিনি নাবালক, নাক টিপলে দুধ বের হয়! এর থেকেই বোঝা যায় শুধু আওয়ামী লীগ নয়, তাদের সরকারের সঙ্গে সম্পর্কিত অন্যরাও কীভাবে দুর্নীতির জালে জড়িত হয়ে নিজেদের আখের গোছাচ্ছেন!!

যুবলীগের ক্যাসিনো বাণিজ্যের সঙ্গে পুলিশের সম্পর্ক বিষয়ে ২০ সেপ্টেম্বর যুগান্তরের প্রথম পৃষ্ঠায় এক রিপোর্টে বলা হয়, ‘ক্যাসিনো থেকে নিয়মিত মোটা অঙ্কের মাসোহারা পেতেন রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার থানার ওসি, এডিসি এবং ডিসি। মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) নামে চাঁদা তোলা হতো। এমনকি ঢাকা মহানগর পুলিশের উচ্চপদস্থ বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা নিয়মিত ক্যাসিনো থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিতেন। বিদেশ ভ্রমণে গেলে তাদের মোটা অঙ্কের বিদেশি মুদ্রা কিনে দিতে হতো। এমনকি পুলিশের প্রভাবশালী কয়েকজন কর্মকর্তা বিদেশের ব্যয়বহুল হাসপাতালে চিকিৎসা করান। পরে যার বিল মিটিয়েছেন খালেদ।’

যুবলীগ নেতা খালেদ ও সম্রাট সম্পর্কে যুগান্তর, ডেইলি স্টার ইত্যাদি পত্রিকায় যেসব দীর্ঘ রিপোর্ট বের হয়েছে তার বিস্তারিত বিবরণ এখানে দেয়া সম্ভব নয়। তবে এ রিপোর্টে দেখা যায়, সম্রাট নামে যুবলীগের প্রধান নেতা এতই দুর্নীতিগ্রস্ত এবং এত কোটি কোটি টাকার মালিক যে, সে প্রত্যেক মাসে অন্তত ১০ দিন সিঙ্গাপুরে থেকে সেখানে জুয়া খেলা, মদ ও নারীঘটিত ব্যাপারে মশগুল থেকে আমোদ-ফুর্তি করে। বাকি ২০ দিন ঢাকায় থেকে যাপন করে একই ধরনের জীবন। সে এখন পলাতক আছে।

২১ সেপ্টেম্বর যুগান্তরের প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত এক রিপোর্টে অন্য এক যুবলীগ নেতা সম্পর্কে বলা হয়, ‘যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদের পর এবার গ্রেফতার হলেন সংগঠনটির আরেক প্রভাবশালী নেতা এসএম গোলাম কিবরিয়া শামীম ওরফে জি কে শামীম। যিনি টেন্ডারবাজ ও চাঁদাবাজ হিসেবে সবার কাছে ব্যাপক পরিচিত।

শুক্রবার দুপুরে রাজধানীর গুলশানের নিকেতনে নিজ ব্যবসায়িক কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। অভিযানে তার সাত দেহরক্ষীকেও গ্রেফতার করা হয়। এ সময় নগদ ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা, ১৬৫ কোটি টাকার স্থায়ী আমানতের (এফডিআর) কাগজপত্র, তার একটি আগ্নেয়াস্ত্র, দেহরক্ষীদের সাতটি শর্টগান-গুলি এবং কয়েক বোতল বিদেশি মদ জব্দ করা হয়।’

এ পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘দল ও সহযোগী সংগঠনগুলোর মধ্যে শুদ্ধি অভিযান প্রসঙ্গে কোনো নালিশ শুনতে চাই না। ছাত্রলীগের পর যুবলীগকে ধরেছি। একে একে সব ধরব’ (যুগান্তর, ২০.০৯.২০১৯)। কিন্তু এভাবে কি কোনো ‘শুদ্ধি’ অভিযান সফল হওয়া সম্ভব? ছাত্রলীগের দু’জন শীর্ষ নেতাকে এক ধরনের শাস্তি দেয়া হয়েছে। ছাত্রলীগের নেতৃত্ব থেকে তাদের অপসারণ করা হয়েছে। কিন্তু একটা বড় সংগঠনের দু’জন নেতাকে শাস্তি দিয়েই কি সেই সংগঠনকে শুদ্ধ করা যায়? ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যসব বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগ টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি করে এসেছে।

এ সবই তারা করেছে আওয়ামী লীগ ও সরকারের নাকের ডগায়। শুধু তাই নয়, এদের ব্যবহার করেই আওয়ামী লীগ তার সাংগঠনিক তৎপরতা অনেকাংশে চালিয়ে এসেছে। কাজেই তাদের সবার কার্যকলাপ সম্পর্কে তারা কিছু জানতেন না এবং হঠাৎ করে এখন জেনেছেন, এটা তো ঠিক নয়। কাজেই যে সংগঠনকে তারা দুর্নীতিতে ডুবে থাকতে দেখেছেন এবং দেখেও দেখেননি, তাকে কি এত সহজে শুদ্ধ করা যায়? যুবলীগের ক্ষেত্রেও এই একই কথা। এ সংগঠনে পচন যেভাবে ধরেছে, চরম দুর্নীতিতে এর সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা এতদিন যেভাবে গা ভাসিয়ে দিয়ে অগাধ ধন-সম্পত্তির মালিক হয়েছে, তাকে শুদ্ধ করা এত সহজে সম্ভব নয়।

তাছাড়া শুধু ছাত্রলীগ ও যুবলীগই নয়, আওয়ামী লীগের প্রতিটি অঙ্গসংগঠনই যেভাবে দুর্নীতিতে লিপ্ত থেকেছে, এর থেকে খোদ আওয়ামী লীগ কি মুক্ত? এটা কি হতে পারে? আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠনগুলো দুর্নীতিগ্রস্ত এবং আওয়ামী লীগ শুদ্ধ, এটা কি হতে পারে? কাজেই আওয়ামী লীগের মধ্যেও দুর্নীতির অবাধ রাজত্ব। আওয়ামী লীগের মধ্যে এটা এক মহাসংকটের সৃষ্টি করেছে। আসলে হঠাৎ করে আওয়ামী লীগ তাদের অঙ্গসংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে শুরু করার কারণ এই সংগঠনগুলো তাদের মূল রাজনৈতিক দল ও সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে এমন শক্তিশালী হয়ে উঠেছে যে তারা আওয়ামী লীগ ও সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। এ পরিস্থিতিতে তাদের নিয়ন্ত্রণে ফিরিয়ে আনার জন্যই এখন অভিযান চালানো হচ্ছে।

কিন্তু এ অভিযান চালানো হলেও এটা মনে রাখা দরকার যে ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ইত্যাদি অঙ্গসংগঠনগুলোর ওপরে নির্ভর করেই আওয়ামী লীগ সংগঠন দাঁড়িয়ে আছে। শুদ্ধি অভিযানের নামে এগুলোর বিরুদ্ধে এখন যে ধরনের পদক্ষেপ সরকার নিচ্ছে সেটা দাঁড়িয়েছে, যে ডালের উপর তারা বসে আছে সেই ডালটি কেটে ফেলা। কাজেই এর পরিণতি কী হবে তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর