দান আসলে কী, কেন ও কিভাবে

হান করা একটি অতি মহৎ কাজ। মানুষের কল্যাণে নিজের অর্থ-সম্পদ ব্যয় বা প্রদান করাকে দান করা বলা হয়। দান বিভিন্ন প্রকারের হয়। সরকার তার নাগরিকদের কাছে দেশ রক্ষার্থে তথা জনগণের নিরাপত্তার স্বার্থে অর্থ-সম্পদ সাহায্য চাইলে জনগণ স্বেচ্ছায় তা দিলে তা হচ্ছে এক প্রকার দান। যেমন তাবুক যুদ্ধ অভিযানের প্রাক্কালে মদিনাভিত্তিক রাষ্ট্রের প্রধান মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর আহ্বানে সাহাবিরা অকাতরে যুদ্ধ তহবিলে দান করেন। এমনকি নারীরাও গলার হার, হাতের চুড়ি, কানের দুল, আংটি ইত্যাদি যার যা ছিল তা এ তহবিলে দান করেন। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে যেমন ঘূর্ণিঝড়, বন্যা ইত্যাদিতে ক্ষতিগ্রস্ত অসহায় মানুষকে অর্থ দিয়ে, জিনিসপত্র দিয়ে সাহায্য করাটাও হচ্ছে একটা দান। মসজিদ, মাদরাসা, স্কুল, কলেজ ইত্যাদি আল্লাহর ওয়াস্তে প্রতিষ্ঠা করাটাও আরেক প্রকারের দান। আর গরিবকে কেউ যদি অর্থ-সম্পদ প্রদানের মাধ্যমে সাহায্য করে, তা হচ্ছে একটি অন্যতম দান। তবে দান করা বলতে মানুষ সাধারণত গরিবদের অর্থ-জিনিসপত্র দিয়ে, খাওয়া দিয়ে সাহায্য করাটাকেই বোঝে। এ দানগুলো আল্লাহর ওয়াস্তে অর্থাৎ আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য মানুষের কল্যাণে দান করলে তখন একে আল্লাহর রাস্তায় দান হিসেবে গণ্য করা হয়।

দান করার ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে বিশ্বাসীরা! তোমাদের আমি যা দিয়েছি তা থেকে দান করো সেই দিন আসার আগে, যেদিন কোনো রকম বেচাকেনা, বন্ধুত্ব এবং সুপারিশ থাকবে না।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৫৪)

অত্র আয়াতের অর্থ হচ্ছে কোনো সামর্থ্যবান মানুষের মৃত্যু আসার আগেই তাকে মহান আল্লাহ দান করতে বলেছেন, যাতে সে গড়িমসি করে দান করতে ব্যর্থ না হয়। এর দ্বারা দান করা বিষয়টি যে কী গুরুত্বপূর্ণ, তা বোঝা যায়!

দান প্রদানে কাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে, সে ব্যাপারে হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘মিসকিনদের দান করলে তা শুধু একটি দান হিসেবে পরিগণিত হবে। কিন্তু গরিব নিকটাত্মীয়কে দান করলে তাতে দ্বিগুণ সওয়াব হয়। একটি দানের, অন্যটি আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার।’ (তিরমিজি ও নাসাঈ)

কী উদ্দেশ্যে দান করতে হবে সে ব্যাপারে কোরআন শরিফে বলা হয়েছে, ‘…তোমরা যা কিছু দান করো তা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই করো, আর যা কিছু তোমরা দান করো, তার পুরস্কার পুরোপুরি প্রদান করা হবে।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৭২)

আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্য ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্যে এ দান প্রদান করা হলে পরকালে আল্লাহ এ দানের পুরস্কার দেবেন না। দান করার পর দানকারী যদি দান গ্রহণকারীকে দানের জন্য খোঁটা দিয়ে কষ্ট দেয়, তাহলে ওই দান ফলশূন্য হয়ে যায়। সে প্রসঙ্গে কোরআন শরিফে বলা হয়েছে, ‘যে দানের পর কষ্ট দেওয়া হয় তার থেকে সুন্দর কথা বলা এবং মাফ চাওয়া উত্তম…।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৬৩)

কোনো গরিব লোক অর্থ বা জিনিসপত্র দান হিসেবে নিলে দানকারী তাকে এ দানের ব্যাপারে খোঁটা দিয়ে কষ্ট দেওয়া উচিত নয়। দানের জন্য দান গ্রহণকারীকে কষ্ট দেওয়ার চেয়ে তাকে দান প্রদান না করে তার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা এবং তাকে দান প্রদান না করার জন্য মাফ চাওয়াই হচ্ছে উত্তম।

দানের কথা প্রচার করা উচিত নয়। এ ব্যাপারে কোরআন শরিফে বলা হয়েছে, ‘হে বিশ্বাসীরা! তোমরা দানের কথা প্রচার করে এবং (দান গ্রহণকারীকে) কষ্ট দিয়ে তোমাদের দানকে বরবাদ করে দিয়ো না, ঠিক ওই লোকের মতো যে শুধু লোক দেখানোর উদ্দেশ্যেই দান করে…।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৬৪)

দান প্রকাশ্যে বা গোপনে প্রদানের ব্যাপারে কোরআন শরিফে বলা হয়েছে, ‘তোমরা যদি প্রকাশ্যে দান করো তা ভালো, আর যদি গোপনে তা করো এবং অভাবীকে দাও, তবে তা হবে তোমাদের জন্য আরো ভালো; এতে আল্লাহ তোমাদের কিছু কিছু পাপ মুছে দেবেন…।’ (সুরা : বাকারা : ২৭১)

প্রকাশ্যে দান করা ভালো; এটা এ জন্য যে এ দানের দেখাদেখি অনেকেই দান করতে উৎসাহী হতে পারে। আর গোপনে দান করা আরো ভালো। কারণ এভাবে দান করলে দানকারী লোক দেখানো কাজ তথা ‘রিয়া’ থেকে সহজেই বাঁচতে পারে এবং দান গ্রহীতারা যারা চায় না লোকজন এ দানের কথা জেনে তাদের হেয় মনে করুক, তা থেকে তারা রক্ষা পেতে পারে। এ আয়াত থেকে দেখা যায়, দান করলে আল্লাহ কিছু কিছু পাপ মোচন করে দেবেন।

দান করলে আল্লাহর কাছ থেকে পরকালে কী কী প্রতিদান পাওয়া যাবে সে ব্যাপারে কোরআন শরিফে বলা হয়েছে, ‘যারা দিন-রাত প্রকাশ্যে ও গোপনে তাদের ধন-সম্পদ দান করে, তাদের জন্য তাদের প্রতিপালকের কাছে পুরস্কার রয়েছে; তাই তাদের কোনো ভয় নেই এবং তারা কোনো দুঃখও পাবে না।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৭৪)

কিয়ামতের দিন গোপনে দানকারী আল্লাহর আরশের নিচে ছায়া লাভ করবে। হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘কিয়ামতের দিবসে সাত শ্রেণির লোক (আল্লাহর) আরশের নিচে ছায়া লাভ করবে।’ এর মধ্যে এক শ্রেণি হচ্ছে, ‘ওই ব্যক্তি এত গোপনে দান করে যে, তার ডান হাত কী দান করে বাম হাত তা জানতেই পারে না।’ (বুখারি ও মুসলিম)

দান দোজখের আগুন থেকে বাঁচায়। হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘খেজুরের একটি অংশ দান করে হলেও তোমরা দোজখের আগুন থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা করো।’ (বুখারি ও মুসলিম)

দান করার দ্বারা শুধু যে পরকালেই উপকার পাওয়া যাবে তা নয়, এর দ্বারা ইহকালেও উপকার পাওয়া যায়। হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘দান আল্লাহর অসন্তুষ্টি লাঘব করে এবং লাঞ্ছিত মৃত্যু (খারাপ মৃত্যু বা অপমৃত্যু) প্রতিরোধ করে।’ (তিরমিজি)। দান করা সম্পর্কে হজরত মুহাম্মদ (সা.) আরো বলেছেন, ‘তোমরা দান করার ব্যাপারে তাড়াতাড়ি করবে, কেননা বিপদাপদ উহাকে (দানকে) অতিক্রম করতে পারে না।’ (মেশকাত শরিফ)। অর্থাৎ দানের দ্বারা বিপদাপদ দূরীভূত হয়। দানের দ্বারা অভাবী মানুষ অর্থ ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র যা পায় তার দ্বারা তাদের অসহায়ত্ব কাটার পথ সুগম হয়। এটা সমাজে সুখ-শান্তি স্থাপনে ও বজায় রাখতে এবং সামাজিক পরিবেশ ভালো রাখতে সহায়তা করে। এ ছাড়া দানের দ্বারা স্থাপিত স্কুল, কলেজ, মাদরাসা, হাসপাতাল ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান জনগণের তথা দেশের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধিতেও অবদান রাখে। এতে সদকায়ে জারিয়ার সওয়াব হতে থাকে। সর্বোপরি দানের দ্বারা শুধু সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরাই উপকৃত হয় না, এর দ্বারা সমাজ ও দেশ উপকৃত হয়।

 

 

 

 

 

 

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর