মিন্নির জামিনের পূর্ণাঙ্গ রায়: বরগুনার এসপি’র পেশাদারিত্ব প্রশ্নবিদ্ধ

বরগুনার আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় তার স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নিকে হাইকোর্টের দেওয়া জামিনের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হয়েছে। রায়ে বলা হয়েছে, আসামির আদালতে স্বীকারোক্তির আগেই পুলিশ সুপারের (এসপি) গণমাধ্যমে দেওয়া বক্তব্য অযাচিত, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের পরিপন্থী। গণমাধ্যমে বক্তব্য দিয়ে তিনি (পুলিশ সুপার) তার পেশাদারিত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন।

রোববার (১ সেপ্টেম্বর) সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে সাট পৃষ্ঠার রায়টি প্রকাশ হয়েছে।

গত বৃহস্পতিবার (২৯ আগস্ট) বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমান সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চ মিন্নির জামিন প্রশ্নে জারি করা রুল যথাযথ ঘোষণা করে তাকে শর্তাধীন জামিন দেন। পূর্ণাঙ্গ রায় লিখেছেন বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম। তার সঙ্গে একমত হয়েছেন অপর বিচারপতি।

পূর্ণাঙ্গ রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, ‘একজন আসামি রিমান্ডে থাকাবস্থায় আইনের নির্ধারিত নিয়মে সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট জবানবন্দি প্রদানের পূর্বেই পুলিশ সুপারের (মারুফ হোসেন) এ ধরনের বক্তব্য তদন্ত সম্পর্কে জনমনে নানাবিধ প্রশ্ন ও বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। তার বক্তব্যের বিষয়াদি যদি সত্য ধরেও নেওয়া হয়, তাহলেও গণমাধ্যমের সামনে এ পর্যায়ে প্রকাশ ছিল অযাচিত এবং ন্যায়-নীতি, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের পরিপন্থী। একজন দায়িত্বশীল অফিসারের কাছ থেকে এ ধরনের কাজ প্রত্যাশিত ও কাম্য ছিল না। তিনি নিজেই তার দায়িত্বশীলতা ও পেশাদারিত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন, যা দুঃখ ও হতাশাজনক।’

রায়ে বলা হয়, ‘মামলার তদন্ত যেহেতু চলমান, সেকারণে এ বিষয়ে আদালত এই মুহূর্তে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত প্রদান করা থেকে বিরত থাকছে। তদন্ত শেষে পুলিশ রিপোর্ট দাখিল হলে পুলিশের মহাপরিদর্শক এ বিষয়ে সামগ্রিক অবস্থা বিবেচনায় প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। এখানে প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ করা খুবই সঙ্গত হবে যে, ইদানীং প্রায়শ লক্ষ্য করা যায় যে, বিভিন্ন আলোচিত অপরাধের তদন্ত চলাকালীন সময়ে পুলিশ-র‌্যাবসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক গ্রেফতারকৃত অভিযুক্ত ব্যক্তিদের সংশ্লিষ্ট আদালতে হাজির করার পূর্বেই বিভিন্নভাবে গণমাধ্যমের সামনে উপস্থাপন করা হয়, যা অনেক সময় মানবাধিকারের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে অমর্যাদাকর এবং অ-অনুমোদনযোগ্য; এবং বিভিন্ন মামলার তদন্ত সম্পর্কে অতি উৎসাহ নিয়ে গণমাধ্যমের সামনে ব্রিফিং করা হয়ে থাকে। আমাদের সকলকে স্মরণ রাখতে হবে যে, যতক্ষণ পর্যন্ত আদালতে একজন অভিযুক্ত বিচার প্রক্রিয়া শেষে সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে দোষী সাব্যস্ত না হচ্ছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত চূড়ান্তভাবে বলা যাবে না যে, তিনিই প্রকৃত অপরাধী বা তার দ্বারাই অপরাধটি সংঘটিত হয়েছে। গণমাধ্যমের সামনে গ্রেফতারকৃত কোনো ব্যক্তিকে এমন ভাবে উপস্থাপন করা সঙ্গত নয় যে, তার মর্যাদা ও সম্মানহানি হয় এবং তদন্ত চলাকালে অর্থাৎ পুলিশ রিপোর্ট দাখিলের পূর্বে গণমাধ্যমে গ্রেফতারকৃত কোনো ব্যক্তি বা মামলার তদন্ত কার্যক্রম সম্পর্কে এমন কোনো বক্তব্য উপস্থাপন সমীচীন নয়, যা তদন্তের নিরপেক্ষতা নিয়ে জনমনে বিতর্ক বা প্রশ্ন সৃষ্টি করতে পারে।’

আদালত বলেন, ‘আমাদের আরও স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে, মামলার তদন্ত এবং বিচার পর্যায়ে একজন অভিযুক্তের প্রাপ্ত আইনি অধিকার নিশ্চিত করা সংশ্লিষ্ট সকলের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। উপরোক্ত বিবেচনায় আদালতের সুচিন্তিত অভিমত এই যে, গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিদের আদালতে উপস্থাপনের পূর্বেই গণমাধ্যমের সামনে উপস্থাপন এবং কোনো মামলার তদন্ত চলাকালীন সময়ে তদন্ত বিষয়ে কতটুকু তথ্য গণমাধ্যমের সামনে প্রকাশ করা সমীচীন হবে সে সম্পর্কে একটি নীতিমালা অতি দ্রুততার সঙ্গে প্রণয়ন করা বাঞ্ছনীয়। এই নীতিমালা প্রণয়ন ও যথাযথভাবে অনুসরণের জন্য সচিব, জননিরাপত্তা বিভাগ/সুরক্ষা বিভাগ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং পুলিশের মহা পরিদর্শককে নির্দেশ প্রদান করা হলো।’

আদালত আরও বলেন, ‘এসব পর্যবেক্ষণ, অভিমত ও নির্দেশনা সহ বর্তমান রুলটি নিরঙ্কুশ করা হলো। আসামি দরখাস্তকারী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নিকে বরগুনার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের সন্তুষ্টি সাপেক্ষে জামিননামা সম্পাদনের শর্তে জামিন প্রদান করা হলো। আসামি কর্তৃক অন্তর্বর্তীকালীন জামিনের সুবিধা অপব্যবহারের অভিযোগ প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্ট আদালত আইনের নির্ধারিত নিয়মে জামিন বাতিল করতে পারবে। জামিনে থাকাবস্থায় আসামি আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি পিতার হেফাজতে থাকবেন এবং তিনি গণমাধ্যমে কথা বলা থেকে নিজেকে বিরত রাখবেন। এই রায় ও আদেশের অনুলিপি প্রয়োজনীয় অবগতি ও ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট আদালতসহ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ/সুরক্ষা বিভাগের সচিব ও পুলিশের মহাপরিদর্শকের কাছে অবিলম্বে প্রেরণ করা হোক।’

এর আগে ২০ আগস্ট মিন্নিকে কেন জামিন দেওয়া হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছিলেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে ২৮ আগস্ট মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকে সিডি (কেস ডকেট) নিয়ে হাইকোর্টে হাজির হতে বলা হয়। এছাড়া মিন্নির দোষ স্বীকার নিয়ে সংবাদ সম্মেলনের বিষয়ে পুলিশ সুপারকে (এসপি) লিখিত ব্যাখ্যা দিতেও বলা হয়।’

গত ৮ আগস্ট বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমান সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের অবকাশকালীন দ্বৈত বেঞ্চ মিন্নির জামিন না রদিয়ে রুল জারি করতে চাইলে আইনজীবীরা আবেদন ফেরত নেন। এরপর গত ১৮ আগস্ট হাইকোর্টের রায় প্রদানকারী বেঞ্চে এটি দাখিল করা হয়।

২৬ জুন প্রকাশ্য দিবালোকে বরগুনা সরকারি কলেজ রোডে রিফাত শরীফকে কোপাতে থাকে সন্ত্রাসীরা। স্ত্রী মিন্নি রিফাতকে রক্ষার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। পরে বরিশাল শেরে বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। ২ জুলাই ভোরে প্রধান অভিযুক্ত নয়ন বন্ড পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন।

১৬ জুলাই সকালে মিন্নিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বরগুনার পুলিশ লাইনে নিয়ে যাওয়া হয়। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে রিফাত হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ততার অভিযোগে ওই দিন রাত ৯টার দিকে মিন্নিকে গ্রেফতার দেখায় পুলিশ।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর