কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে

কৃষি মজুরি হিসেবে পুরুষ যদি ১০০ টাকা পান, নারী পান ৭৫ টাকা। সাত বছর আগে একই কাজের জন্য নারী পেতেন ৪৮ টাকা। আগের তুলনায় মজুরি বাড়ায় কৃষি কাজে উৎসাহিত হচ্ছে নারীরা।

গ্রামে কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি, ক্যাশ ফর ওয়ার্কসহ নানা সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে নারীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে। নারীও আগের চেয়ে তার অধিকারে সোচ্চার। তাই এবারের আন্তর্জাতিক গ্রামীণ নারী দিবসের প্রতিপাদ্য ‘ভূমি এবং সম্পদে অধিকারের দাবিতে সোচ্চার হও নারী। ভূমি ছাড়া জীবন অর্থহীন।’

দুই বছর ধরে দেশে নারী-পুরুষের মজুরিবৈষম্য ১০ শতাংশ হারে কমছে। সাত বছর আগেও দেশে নারী শ্রমিকেরা পুরুষের অর্ধেকেরও কম মজুরি পেতেন। চলতি বছরের মে মাসের মজুরির হিসাবে এই পার্থক্য ২৫ শতাংশে নেমে এসেছে।

ফরিদপুরের নারী কৃষক হাজেরা বেগম বলেন, ‘আমরা নারীরা মাঠে-ঘাটে কাজ করছি, উৎপাদন করছি। পুরুষের চেয়েও বেশি কাজ করছি। তাই সবার মজুরি এক হওয়া উচিত। তিনি আরো বলেন, সুযোগ-সুবিধা পেলে গ্রামীণ নারীরা কৃষি ও উৎপাদনে আরো বেশি অবদান রাখতে পারবে।’

গত মে মাসে করা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ কৃষি মজুরিবিষয়ক জরিপ প্রকাশ করে।

কৃষি খাতে পুরুষের গড় মজুরি দিনের খাবার ছাড়া ৩২২ টাকা ও খাবারসহ ৩০০ টাকা। আর নারীদের মজুরি খাবার ছাড়া ২৪৪ টাকা ও খাবারসহ ২২৫ টাকা।

বিবিএসের মজুরি পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, দেশে পুরুষেরা সবচেয়ে বেশি মজুরি পান কক্সবাজার জেলায়, দিনে ৪২৮ টাকা। ওই জেলার নারীরা পান ৩২৫ টাকা। নারীরা সবচেয়ে কম মজুরি পান নীলফামারী জেলায়, ১৬৩ টাকা। আর পুরুষেরা সবচেয়ে কম মজুরি পান চুয়াডাঙ্গায়, ২১৩ টাকা।

এ ব্যাপারে পরিসংখ্যান ব্যুরোর যুগ্ম-পরিচালক ও কৃষি শাখার প্রধান বিধান বড়াল বলেন, গ্রামীণ পুরুষের একটি বড় অংশ বর্তমানে প্রবাসী শ্রমিক এবং দেশের বিভিন্ন শহরাঞ্চলে ও শিল্পে শ্রমিক হিসেবে কাজ করছে। ফলে কৃষিকাজে নারীদের অংশগ্রহণ ও মজুরি দুটিই বাড়ছে। তাই খাসজমি ও জলাভূমিতেও নারীর সম-অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

বেসরকারি সংগঠন অক্সফামের ২০১৫ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিশ্বের কৃষি খাতে নারীর কাজের অবদান ৬৬ শতাংশ। অন্যদিকে বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ২০১১ সালের সমীক্ষায় বলা হয়েছে, পৃথিবীর মোট ৮৩ দশমিক ৬ শতাংশ অপুষ্ট জনগোষ্ঠীর মধ্যে নারীর সংখ্যা ৫০ কোটি। কৃষি খাতে নারীর অবদান ৬১ শতাংশ হলেও ভূমিতে নারীর মালিকানা মাত্র ১৮ শতাংশ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সাদেকা হালিম ভূমিহীন নারীদের জন্য সংসদে কোটা সংরক্ষণের দাবি জানান।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের খাদ্য পরিধারণ ও মূল্যায়ন ইউনিটের (এফপিএমইউ) ২০১৫ সালের পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনেও কৃষিতে নারীদের মজুরি বেড়ে যাওয়ার তথ্য উঠে এসেছে। সংস্থাটির ‘জাতীয় খাদ্যনীতি ও কর্ম-পরিকল্পনা এবং দেশীয় বিনিয়োগ পরিকল্পনা পর্যবেক্ষণ’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাত বছর ধরে ধারাবাহিকভাবেই মজুরিবৈষম্য কমলেও ২০১৩-১৪ সালে বৈষম্য কমেছে সবচেয়ে বেশি, অর্থাৎ ১০ শতাংশ কমেছে। বর্তমানে একজন পুরুষ দৈনিক মজুরি দিয়ে নয় কেজি এবং নারীরা ছয় কেজি চাল কিনতে পারেন।

এফপিএমইউর রিপোর্ট ২০১৫ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত কয়েক বছরে নারী শ্রমিকের দক্ষতা ও চাহিদা বেড়ে যাওয়া ও গ্রামীণ পুরুষের বড় অংশ প্রবাসী শ্রমিক হিসেবে রূপান্তর এবং পুরুষ শ্রমিকদের অন্য খাতে স্থানান্তরের কারণে গ্রামে কৃষি-মজুরের সঙ্কট দেখা দিচ্ছে। ওই শ্রমের ঘাটতি নারীরা পূরণ করে কৃষিকে এগিয়ে নিচ্ছেন।

এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণের গুরুত্ব দিয়ে বলেন, গ্রামীণ নারীদের উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দুতে আনতে হবে। তাদের কাজের স্বীকৃতি না দিয়ে উন্নয়ন সম্ভব নয়। নারীদেরও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা থাকতে হবে।

এ বিষয়ে খাদ্যনীতিবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (ইফপ্রি) বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আখতার আহমেদ বলেন, কৃষিতে নারী শ্রমের সাথে গ্রামীণ অর্থনীতির কাঠামোগত বদলের সম্পর্ক আছে। গ্রামে কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি, ক্যাশ ফর ওয়ার্কসহ নানা সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে নারীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে। ক্ষুদ্র ঋণের আওতায় নারীদের সংখ্যাই বেশি। ফলে কৃষিকাজে মজুরি নিয়ে দরদাম করার সুযোগ পাচ্ছেন নারীরা। আর এতেই নারী-পুরুষের মজুরিবৈষম্য কমে আসছে বলে মনে হচ্ছে।

বিবিএস’র সর্বশেষ ২০১০ সালের শ্রমশক্তি জরিপে দেখা গেছে, দেশে কৃষি কাজে নিয়োজিত শ্রমশক্তির সংখ্যা দুই কোটি ৫৬ লাখ। এর মধ্যে নারী প্রায় এক কোটি পাঁচ লাখ। এক দশক আগেও নারীদের এ সংখ্যা ছিল ৩৮ লাখ। অর্থাৎ ১০ বছরের ব্যবধানে কৃষিকাজে যুক্ত হয়েছেন ৬৭ লাখ নারী। তবে এক দশক ধরে প্রতিবছর কৃষিকাজে চার শতাংশ হারে কৃষি শ্রমিক বাড়লেও তা মূলত নারীনির্ভর। আর পুরুষের অংশগ্রহণ কমেছে সাড়ে তিন শতাংশ।

সূত্র : বাসস

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর