কিশোরগঞ্জের হাওরে ভ্রমণপিপাসুরা ছুটছে

হাওর বার্তা ডেস্কঃ বর্ষার হাওর এখন কূলহীন সাগর। চারদিকে বিশাল জলরাশি। এর বুকে বিচ্ছিন্ন গ্রামগুলোর একেকটাকে ছোট দ্বীপের মতো লাগে। দূর থেকে মনে হয়, কচুরিপানা হয়ে যেন পানিতে ভাসছে গ্রামগুলো। হাওরজুড়ে গলা ডুবিয়ে থাকে হিজল গাছের সারি। পানির নিচ থেকে জেগে ওঠা করচের বন, হাঁসের ডিমের মতো সাদা ফল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বরুন গাছ, কিংবা গাঙ্গেয় মিঠা পানিতে শুশুকের লাফ-ঝাঁপ দেখলে বিনোদিত না হয়ে পারা যায় না। এই সৌন্দর্য মন কাড়ে যে কারও। ভ্রমণপিপাসুদের জন্য যেন সৌন্দর্যের বিপুল পসরা সাজিয়ে বসে আছে হাওর।

প্রতি বর্ষাতেই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ ঘুরতে আসেন এই হাওরে। এবারের ঈদ যেন দর্শণার্থীদের আরো বেশি হাওরপ্রেমী করে তুলেছে। মানুষজন দলবেঁধে ছুটছেন হাওরের বিভিন্ন মনোরম স্থানে। জেলার হাওরের পাড়ে পাড়ে এখন ভ্রমণপিপাসুদের কলরব। তাদের বাঁধভাঙা ঢল আর উচ্ছ্বাসে মাতোয়ারা হাওর যেন পরিণত হয়েছে পর্যটনের এক স্বর্গপুরীতে। শুকনো মৌসুমে হাওর মানে মাইলের পর মাইল ফসলি জমি, ধুলোউড়া মেঠোপথ, রুপালি নদী। বর্ষায় এই রুপালি নদীগুলোই ফুঁসে উঠে। দুই তীর ছাপিয়ে প্লাবিত করে ফসলি মাঠ। এই প্লাবিত মাঠই বর্ষার হাওর।

হাওর অধ্যুষিত অন্যতম একটি জেলা কিশোরগঞ্জ। এই বর্ষায় অন্যবছরের চেয়ে হাওরে পানি তুলনামূলকভাবে বেশি এসেছে। এই পানির টানে এবারের ঈদে হাওরের বেশ কয়েকটি স্থানে ঢল নেমেছে দর্শনার্থীদের। এরমধ্যে রয়েছে করিমগঞ্জ উপজেলার চামড়াঘাট, বালিখলা ও হাসানপুর ব্রিজ, ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম সংযোগ সড়ক ও বেড়িবাঁধ, শিমুলবাঁকের হিজলবন, মিঠামইনের কামালপুরে প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদের বাড়ি, দিল্লির আখড়া, নিকলী বেড়িবাঁধ, ছাতিরচরের হিজলবন এবং তাড়াইলের হিজলজানি হাওর।

কিশোরগঞ্জ জেলা শহর থেকে সবচেয়ে কাছে হাওরের স্পর্শ পাওয়া যায় করিমগঞ্জ উপজেলার বালিখলা এলাকায়। বালিখলা থেকে মিঠামইনে যাওয়ার পথে হাওরের পানিতে ভাসছে একটি সেতু। হাসানপুর গ্রামের পাশে গড়াভাঙ্গা নদীর উপর নির্মিত এই সেতুটি হাসানপুর ব্রিজ নামে পরিচিত। প্রায় ১৫৭ মিটার দীর্ঘ ব্রিজের সাথে রয়েছে ১.১৭ কিলোমিটার অলওয়েদার সড়ক ও ১.৬৫ কিলোমিটার সাবমার্সিবল সড়ক। এবারের ঈদে জেলার হাওরের দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দপর্যটকের ঢল নেমেছে বালিখলা এলাকায়।

বালিখলা এলাকায় সড়কের পাশে দাঁড়িয়ে তারা হাওরের বিপুল সৌন্দর্য উপভোগ করছেন। অনেকেই আবার হাওরের বহমান পানির স্রোতে গা ভাসিয়ে দিচ্ছেন। বালিখলা ঘাট থেকে নৌকা ভাড়া নিয়ে অনেকেই ছুটছেন হাওর ভ্রমণে। নৌকাযোগে ছুটে যাচ্ছেন অদূরের হাসানপুর ব্রিজে। সেখানে ফটোসেশন, আড্ডা আর ঘুরেফিরে সময় কাটানোর পাশাপাশি ব্রিজের সাবমার্চেবল সড়ক অংশে পা ভেজাচ্ছেন হাওরের জলে। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে হাওরের সৌন্দর্যের টানে প্রতিদিন ভ্রমণপিপাসু মানুষ দলবেঁধে ছুটে আসছেন।

বালিখলা ও হাসানপুর ব্রিজ ছাড়াও হাওর উপজেলা ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম ও নিকলীতে রয়েছে বেশ কয়েকটি বেড়িবাঁধ। নির্মিত হচ্ছে উপজেলাগুলোর সংযোগ সড়ক। এসব বেড়িবাঁধ বা সড়কে দাঁড়িয়ে সামনের দিকে তাকালে ৩০-৩৫ কিলোমিটারের মধ্যে কোনো গ্রাম চোখে পড়ে না। বাঁধ বা সড়কে দাঁড়িয়ে হাওর দেখা সাগর দেখার মতোই উপভোগ্য। হাজারো দর্শনার্থী রোজ ছুটছেন হাওরের নির্মল বাতাসে বুকভরে নিঃশ্বাস নেয়ার পাশাপাশি হাওরের সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য।

হাওরের নান্দনিক স্থানের মধ্যে দর্শনার্থীদের কাছে পছন্দের একটি নাম নিকলী বেড়িবাঁধ। নিকলী উপজেলা সদরে হাওরের ঢেউয়ের কবল থেকে রক্ষা করতে ২০০০ সালে প্রায় দুই কিলোমিটার দীর্ঘ এই বেড়িবাঁধটি নির্মাণ করা হয়। পরে ২০১০ সালে নিকলী উপজেলা পরিষদের সামনের প্রতিরক্ষা দেওয়াল বাঁধটিকেও বেড়িবাঁধ আকারে করে এর সাথে সংযুক্ত করা হয়। এরপর থেকেই দীর্ঘ ৬ কিলোমিটারের এই হাওর রক্ষা বাঁধটিকে কেন্দ্র করে নিকলী পর্যটন আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। বর্ষা এলেই জেলা সদরসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে দর্শনার্থীরা ছুটে আসেন নিকলীতে।

ফলে ঈদের আগে থেকেই দর্শণার্থীরা নিকলী বেড়িবাঁধে ভিড় জমাতে থাকেন। ঈদের পর থেকে নির্মল আনন্দের খোঁজে দর্শনার্থীরা বেছে নিয়েছেন হাওরের এই স্থানটিকেই। ফলে সকাল থেকে সন্ধ্যা এমনকি রাত পর্যন্ত সব বয়সীদের উপচে পড়া ভিড় সেখানে লেগেই রয়েছে। এছাড়া নিকলী উপজেলা সদরের সঙ্গে রাজধানী ঢাকাসহ জেলা সদরের সরাসরি সড়ক যোগাযোগ থাকায় সেটিও দর্শনার্থীদের আগ্রহী করছে। নিকলী বেড়িবাঁধ থেকে ইঞ্জিন চালিত নৌকা ও স্পিডবোট ভাড়ায় নিয়ে দর্শণার্থীরা হাওরের মাঝে ভেসে বেড়ানোরও সুযোগ পাচ্ছেন।

স্থানীয়রা বলছেন, এবারের ঈদের পরের দিন থেকে নিকলীতে প্রতিদিন লাখো মানুষ ভিড় করছেন। রোদারপুড্ড সেতু থেকে শুরু হওয়া দর্শনার্থীদের এই ভিড় দেখতেও চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে। দর্শনার্থীরা শুধু হাওর-ই দেখছেন না, ঢেউয়ের সাথে পাল্লা দিয়ে নামছেন গোসল, জলকেলি ও সাঁতারে।

হাওরে বর্ষা থাকে বছরের প্রায় ছয় মাস। পানি আসতে শুরু করে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ থেকে। শেষ হয় আশ্বিন-কার্তিকে। এই পুরো সময় জুড়েই হাওরে পর্যটকদের ভিড় থাকে। শ্রাবণ মাস শেষে এখন ভাদ্র মাস চলছে। হাওরে টুইটম্বুর পানি। ঈদের ছুটিতে হাওরদর্শন যেন ঈদের আনন্দকে আরো বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। ঈদের আমেজে প্রতিদিনই হাওরে ছুটছেন লাখো মানুষ। যেন এক মহামিলনের উৎসবে মাতোয়ারা বিনোদনপ্রেমীরা।

দর্শনার্থীরা বলছেন, প্রতিদিন হাওরে হাজার হাজার মানুষ আসছেন একটু নির্মল আনন্দময় পরিবেশে সময় কাটাতে। হাওরের মতো এমন পরিবেশ এখন আর কোথাও দেখা যায় না।

হাওরে ঘুরতে আসা দর্শণার্থীদের নিরাপত্তার বিষয়ে যথেষ্ট আন্তরিক রয়েছে কিশোরগঞ্জ জেলা পুলিশ। এ ব্যাপারে পুলিশ সুপার মো. মাশরুকুর রহমান খালেদ বিপিএম (বার) বলেন, হাওরের এবার দর্শনার্থীদের বিপুল সমাগম ঘটছে। তবে দর্শনার্থীদের ঝুঁকি নিয়ে ভ্রমণের ব্যাপারে সচেতন থাকা উচিত। নিরাপত্তার বিষয়ে আমাদের পুলিশ সবসময় প্রস্তুত রয়েছে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর