তৃতীয় শক্তি কবে?

‘দুই প্রধান দলের বাইরে বিকল্প খুঁজছে মানুষ’Ñ রাজনৈতিক সংকটের সময় বারবার উচ্চারিত হয় এই কথাটি। গুরুত্ব হারানো রাজনৈতিক নেতা, কথিত রাজনৈতিক বিশ্লেষক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বা কলাম লেখকরা গত এক দশকে এই কথাটি কত শতবার বলেছেন তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু আসলে কি তাই? কোনো নির্বাচনেই এই বিকল্প কারও উল্লেখযোগ্য ভোট পাওয়ার কোনো নজির নেই। আর সামরিক শাসনের অবসানের পর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আসছে আওয়ামী লীগ বা বিএনপি।

গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় বহু দল থাকলেও বেশিরভাগ দেশেই বাংলাদেশের মতোই দুই প্রধান রাজনৈতিক দলকেই রাজনীতিতে গুরুত্ব পেতে দেখা গেছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানেও এই দ্বিদলীয় শাসন ব্যবস্থাকেই সবচেয়ে ভালো বিকল্প হিসেবে ধরা হয়।

মূলত কোনো রাজনৈতিক সংকট তৈরি হলেই বাংলাদেশে আসে এই কথিত তৃতীয় শক্তির প্রসঙ্গ। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির বাইরে তৃতীয় রাজনৈতিক ধারার জন্য জনগণ মুখিয়ে আছে, এ ধরনের প্রচার চলে জোরেশোরে। আর পেশাজীবী, পরিবর্তনের ডাক দিয়ে গড়া সংগঠন, দলে গুরুত্ব হারানো রাজনৈতিক নেতা বা রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লেষ নেই এমন মানুষরাই বেশিরভাগ এ নিয়ে উচ্চবাচ্য করেন।

তবে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, ‘বাংলাদেশে তৃতীয় শক্তি বলতে কিছু নেই, সবই জনগণের শক্তি। জনগণের চাওয়া পাওয়া যারা মেটাতে পারবে তাদেরকেই সমর্থন দেয় তারা।’

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আ স ম হান্নান শাহ বলেন, ‘অনেকে, বিশেষ করে সুশীল সমাজ হিসেবে পরিচিত কেউ কেউ মাঝেমধ্যে বলেন, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি বেশ কয়েকবার শাসন করেছে। এবার অন্য কাউকে সুযোগ দেওয়া যাক। কিন্তু আমার মনে হয় বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরে নিকট- ভবিষ্যতে অন্য কোনো শক্তির বড় হয়ে উঠার সম্ভাবনা নেই।’

বাম ধারার বুদ্ধিজীবী ও জাতীয় তেল-গ্যাস ও বন্দর-বিদ্যুৎ রক্ষা জাতীয় সমিটির সদস্য সচিব আনু মুহম্মদ বলেন, ‘তৃতীয় শক্তি শব্দটা আমারও পছন্দ নয়। তবে জনগণের স্বার্থ রক্ষা করবে এমন একটি শক্তি আসা দরকার’। কেন এই শক্তি আসছে না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘হচ্ছে না বলা যাবে না, কখন শক্তিশালী হবে সেটা প্রশ্ন’। আদৌ এই ধারা কি শক্তিশালী হবে? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সেটা দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক অনেক বিষয়ের ওপর নির্ভর করে’।

সিটি করপোরেশন নির্বাচন একটি শিক্ষা!

সদ্যসমাপ্ত তিন সিটি নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীর বাইরে মেয়র পদে অন্য কোনো প্রার্থীই তেমন কোনো ভোট পাননি। তৃতীয় শক্তি হিসেবে যার নাম গণমাধ্যমে বহুল প্রচারিত হয়েছে সেই বাম নেতা জুনায়েদ আবদুর রহমান সাকি ঢাকা উত্তরে ভোট পেয়েছেন ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থীর অর্ধেকেরও কম। অথচ গণমাধ্যমে তিনি এই সিটিতে দুই প্রধান প্রার্থী আনিসুল হক এবং তাবিথ আউয়ালের মতোই গুরুত্ব পেয়েছেন নির্বাচনী প্রচারের সময়।

এই সিটি নির্বাচনে আলোচিত অন্য প্রার্থীদের মধ্যে সিপিবি সমর্থিত আবদুল্লাহ আল ক্বাফি, আওয়ামী লীগ থেকে বিতাড়িত সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম মওলা রনি পাঁচ হাজার ভোটও পাননি।

মূলত আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে দুই দলের বিরুদ্ধেই অগণতান্ত্রিক আচরণ, দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে। আর তখনই আসে এই কথিত তৃতীয় শক্তির প্রসঙ্গ। এর মধ্যে কেউ কেউ রাজনৈতিক শক্তির উত্থানের কথা বললেও অরাজনৈতিক শক্তির প্রসঙ্গও আসে নানা সময়, যদিও সেই বিষয়টি নিয়ে কেউ তেমন কথা বাড়াতে চান না।

২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর থেকে তৃতীয় শক্তির শব্দটির বহুল ব্যবহার শুরু হয়। সে সময় হঠাৎ সামনে আসেন গ্রামীণ ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। কিন্তু তার নাগরিক শক্তি ফুরিয়ে যায় বিকশিত হওয়ার আগেই। সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা ছাড়ার পর আর রাজনৈতিক অভিলাষ শোনা যায়নি ড. ইউনূসের।

সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেই আলোড়ন তুলে বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য ফেরদৌস আহমেদ কোরেশীর পিডিপি। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টির বেশ কয়েকজন নেতা এই দলে যোগ দিয়েছিলেন। সে সময় সৈয়দ মোহাম্মদ ইব্রাহিমের কল্যাণ পার্টিও আলোড়ন তুলেছিল গণমাধ্যমে। কিন্তু দেশে নির্বাচন এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ফেরার পর গুরুত্ব হারিয়েছেন এই নেতারা। নির্বাচনে অংশ নিলেও কথিত জনপ্রিয়তার ছিটেফোটারও প্রমাণ মেলেনি।

তৃতীয় শক্তি নিয়ে ব্যাপক প্রচার আর দুই প্রধান দলের বিরুদ্ধে গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচারের পরও ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির বাইরে কোনো দল বলার মতো কোনো ভোট পায়নি। দুই প্রধান দলের বাইরে জাতীয় পার্টি ২৮টি আসনে জিতলেও তা তাদের নিজের শক্তিতে জিতেছে কি না সে নিয়ে আছে বিতর্ক। কারণ জাতীয় পার্টি যেসব আসনে তখন জিতেছে, তার সবকয়টিতেই জোটের শরিক হিসেবে তখন সমর্থন দিয়েছে আওয়ামী লীগ। আর যেসব আসন আওয়ামী লীগ এবং জাতীয় পার্টিÑদুই দলের জন্যই উন্মুক্ত ছিল, তার একটিতেও জিততে পারেনি জাতীয় পার্টি। তাই শতকরা হিসেবে জাতীয় পার্টি সাত শতাংশের কিছু বেশি ভোট পেলেও তা এই দলের নিজস্ব ভোট কি না তা বোঝার উপায় নেই। তাছাড়া এরশাদ সরকারের পতনের পর থেকে বৃহত্তর রংপুর ছাড়া দেশের আর কোথাও জাতীয় পার্টি উল্লেখযোগ্য সংখক ভোট পায়নি। বরং বৃহত্তর রংপুরের জাতীয় পার্টির ভোট ক্রমাগত কমছে এবং তাদের বদলে নির্বাচনে জিতে আসছে আওয়ামী লীগ-বিএনপির প্রার্থীরা।

সফল হয়নি মান্নার স্বপ্ন

২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে জেতার পর আওয়ামী লীগে পদ হারানো মাহমুদুর রহমান মান্না আবার আলোড়ন তুলেন বিকল্প শক্তি গড়ার কথা বলে। তার সঙ্গে গণফোরামের সভাপতি কামাল হোসেন, জাসদের একাংশের সভাপতি আ স ম আবদুর রবসহ রাজনীতিতে গুরুত্ব হারানো বেশ কিছু নেতা এবং পেশাজীবীরা একজোট হন, গড়ে তোলেন নাগরিক ঐক্য। সরকারের কঠোর সমালোচনায় বেশ আলোচিত চরিত্র হয়ে উঠেন মান্না। ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঘোষণাও দিয়েছিল তার সংগঠন। কিন্তু রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় গ্রেপ্তারের পর আর মনোনয়নপত্র জমা দেয়নি নাগরিক ঐক্য।

আবার প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির বাইরে বিকল্প শক্তি হিসেবে নিজেদের প্রচার করলেও পরে বিএনপির সঙ্গে নাগরিক ঐক্যের যোগসাজশ প্রমাণ হয়। নাগরিক ঐক্যের কর্মসূচিতে বিএনপি লোক সরবরাহও করত। বিএনপি নেতা সাদেক হোসেন খোকার সঙ্গে মান্নার ফাঁস হওয়া টেলিফোন সংলাপে এসব স্পষ্ট হয়। আর সেনাবাহিনীর সঙ্গে বৈঠক করার অভিপ্রায় প্রকাশের পর মান্নার গ্রেপ্তারের পর তার সঙ্গে আসা অন্যরা পিছুটান দেয়।

বিকল্প শক্তি গড়ার চেষ্টায় ব্যর্থ ড. কামাল হোসেন

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ড. কামাল হোসেন বরাবরই এক পরিচিত নাম। আওয়ামী লীগের নেতা হিসেবেই রাজনৈতিক জীবনে প্রতিষ্ঠিত হন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটিতে ছিলেন তিনি। ছিলেন বঙ্গবন্ধু সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। ড. কামাল হোসেন আওয়ামী লীগের হয়ে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। কিন্তু ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ হেরে যাওয়ার পর দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার সঙ্গে মতবিরোধে দল ছাড়েন তিনি। রাজনীতিতে পরিবর্তনের ঘোষণা দিয়ে গঠন করেন গণফোরাম। শুরুর দিকে বেশ আলোড়ন তুলে কামাল হোসেনের এই দল। আওয়ামী লীগকে গণফোরাম চ্যালেঞ্জে ফেলবে, রাজনৈতিক মহলে এমন কথাও চাউড় হয়।

কামাল হোসেনের সঙ্গে সে সময় স্বচ্ছ ভাবমূর্তির বেশ কয়েকজট ডাকসাইটে আওয়ামী লীগ এবং বাম নেতা যোগ দেন। ন্যাপ থেকে আসেন বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ পঙ্কজ ভট্টাচার্য। সিপিবি থেকে যোগ দেন সাইফউদ্দিন আহমেদ মানিক। আওয়ামী লীগ থেকে যোগ দেন মোস্তাফা মহসীন মন্টু। কিন্তু তারা সুবিধা করতে পারেননি। সম্প্রতি পঙ্কজ ভট্টাচার্য গণফোরাম থেকে বেরিয়ে গেছেন। কামাল হোসেন এখন রাজনীতিতে বলতে গেলে হারিয়ে যেতে বসা এক নাম। কেবল মাঝেমধ্যে গণমাধ্যমে বক্তব্য আসে তার। তাও সুনির্দিষ্ট কোনো কর্মপরিকল্পনার বিষয় আসে না। কেবল জনগণের মধ্যে ঐক্যের ডাক দিলেও সে ঐক্য নিজেরাই কখনো গঠন করতে পারেননি ড. কামাল। নানা সময় বিভিন্ন দলের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার চেষ্টা করলেও পরে সরে এসেছেন নিজেই।

গুরুত্ব হারিয়ে কাদের সিদ্দিকীর দৌড়ঝাঁপ

মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য আবদুল কাদের সিদ্দিকী বরাবরই ছিলেন মানুষের শ্রদ্ধার পাত্র। কিন্তু ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তার ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে উঠে দুর্নীতির অভিযোগ। বিশেষ করে বেশ কিছু সেতুর কার্যাদেশ নেওয়ার পর টাকা নিয়েও তা নির্মাণ করেননি তিনি। এ ছাড়া নিজ দলের সঙ্গে মতবিরোধে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালেই দল থেকে বের হয়ে গঠন করেন কৃষক-শ্রমিক-জনতা লীগ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধেই তার যত অভিযোগ।

২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে টাঙ্গাইলের একটি আসন থেকে জিতেন কাদের সিদ্দিকী। আরও পাঁচটি আসনে বেশ ভালো ভোট পায় দলের প্রার্থীরা। কিন্তু পরে প্রকাশ হয়, বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে গোপন সমঝোতা করেছিল কৃষক-শ্রমিক-জনতা লীগ। আর ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে সে সমঝোতা আর হয়নি আর এই নির্বাচনে বলার মতো কোনো ভোট পাননি এই দলের প্রার্থীরা।

আর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর যুদ্ধাপরাধের বিচারসহ নানা প্রসঙ্গে কাদের সিদ্দিকী বিতর্কিত জন। মানবতাবিরোধী অপরাধে ফাঁসির দ-প্রাপ্ত জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলীর দিগন্ত টেলিভিশনে টক শোর পাশাপাশি নয়া দিগন্ত পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন কাদের সিদ্দিকী। মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদ-ের পর তার ফাঁসির দাবিতে দেশজুড়ে গড়ে উঠা আন্দোলন গণজাগরণের বিরোধিতা করে সমালোচিত হন কাদের সিদ্দিকী। তিনিও এখন রাজনীতিতে এক হারিয়ে যাওয়া মুখে পরিণত হয়েছেন। নতুন দল গঠনের সময় কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন ছাত্রলীগের আলোচিত নেতা ফজলুর রহমান। তিনিও এখন দল ছেড়ে যোগ দিয়েছেন বিএনপিতে।

এখন বিএনপির সঙ্গে সখ্য চান বি. চৌধুরী

বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালীন নেতা এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী রাষ্ট্রপতির পদ ছাড়ার পর গঠন করেন বিকল্পধারা বাংলাদেশ।  সেখানে যোগ দেন বিএনপিরই বেশ কয়েকজন নেতা। সে সময় আলোড়ন তুললেও এখন আবার বিএনপির সঙ্গে সখ্য গড়ার চেষ্টায় এই দলটি।

বিএনপি ছেড়ে নতুন দল গঠনের চেষ্টার সময় বদরুদ্দোজা চৌধুরী এবং তার অনুসারীদের ওপর রাজধানীর মহাখালীতে হামলা করেছিল যুবদল-ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা। বাবার দলে যোগ দেন মুন্সিগঞ্জের একটি আসন থেকে বিএনটির টিকিটে পাস করে আসা মাহী বি. চৌধুরী। আর জাতীয় সংসদ থেকে পদত্যাগ করে উপনির্বাচনে বিএনপির বিরুদ্ধে কুলা মার্কায় নির্বাচন করে জিতে আসেন মাহী বি. চৌধুরী। ঢাকা-১০ আসনের উপনির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী মোসাদ্দেক আলী ফালুর সঙ্গে বিকল্প ধারার প্রার্থী আবদুল মান্নান হেরে গেলেও এই নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ আছে। কিন্তু চার বছরের ব্যবধানে ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে ভোট হারায় বিকল্পধারা। ২০০৭ সালের বাতিল হওয়া জাতীয় নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের সঙ্গে মহাজোটে থাকলেও পরে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আলাদা হয়ে যায় দুই দল।

রাজনীতিতে সুবিধা করতে না পেরে গত কয়েক বছর ধরে বিএনপির সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার চেষ্টায় আছে বিকল্পধারা। সদ্যসমাপ্ত তিন সিটি নির্বাচনের মধ্যে ঢাকা উত্তরে অংশ নিয়ে এক শতাংশেরও কম ভোট পেয়ে জামানত হারিয়েছেন মাহী বি. চৌধুরী। নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী সমর্থনের আগে মাহী বি. চৌধুরী সংবাদ সম্মেলন করে বিএনপির সমর্থন চেয়েও পাননি।

‘ঘৃণিত’ বিএনপি-জামায়াতের কোলে ফিরেছেন অলি আহমদ 

বিএনপিতে থাকাকালে চট্টগ্রামের বিএনপি নেতা অলি আহমদের অবস্থান ছিল দাপুটে। যোগাযোগমন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন তিনি। কিন্তু ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে জোটের শরিক জামায়াতে ইসলামীকে চট্টগ্রামের একটি আসন ছাড়তে রাজি না হওয়ার পর ওই আসনে বিএনপি-জামায়াত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ভোট করে। জামায়াতের বিজয়ের পর বিএনপিতে আগের অবস্থান হারান অলি আহমদ। চারদলীয় জোট সরকারের মন্ত্রিসভায় স্থান হয়নি এই নেতার। এ নিয়ে দলের সঙ্গে সম্পর্কের মারাত্মক অবনতি ঘটে অলি আহমদের।

বিএনপিতে থেকেই দলের বিরুদ্ধে নানা কথা বলতে থাকেন অলি আহমদ। আর ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা জারির পর জোট সরকারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া এবং তার বড় ছেলে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে বেপরোয়া দুর্নীতির অভিযোগ এনে দল ছাড়েন অলি আহমদ। স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতের সঙ্গে রাজনীতি করা সম্ভব নয়Ñএমন মন্তব্য দিয়ে যুদ্ধাপরাধের বিচারের পক্ষেও অবস্থান নেন অলি আহমদ।

বিএনপি চেয়ারপারসনের ঘনিষ্ঠজন সাবেক মন্ত্রী জাহানারা বেগমকে নিয়ে অলি আহমদ গঠন করেন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টিÑএলডিপি। বিএনপির বেশ কয়েকজন সাবেক সংসদ সদস্য এই দলে যোগও দেন। সে সময় আওয়ামী লীগের সঙ্গে যোগাযোগ করে ২০০৭ সালের বাতিল হওয়া নির্বাচনের আগে মহাজোটেও যোগ দেন তিনি।

সে সময় বিকল্পধারার সঙ্গে জোট করে দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক শক্তি হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন অলি আহমদ। কিন্তু সে স্বপ্ন গড়ার আগেই ভেঙে যায়। বি. চৌধুরী এবং অলি আহমদ দুজনই একে অপরের বিরুদ্ধে আত্মম্ভরিতার অভিযোগ এনে জোট ভেঙে দেন। আর ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে মহাজোটের সঙ্গে সম্পর্কও টেকেনি। চট্টগ্রামের একটি আসন থেকে জিতে আসলেও অন্য কোনো নেতা কোনো আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাই করতে পারেননি।

নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর রাজনীতিতে গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেন অলি আহমদ। গণমাধ্যমও তার কাছে আগের মতো যায়নি আর। এই অবস্থায় সেই ‘ঘৃণিত’ বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে আওয়ামী লীগবিরোধী জোটে যোগ দিয়েছেন অলি আহমদ। আগের অবস্থান থেকে সরে এসে এখন মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের সমালোচনা করে বক্তব্য রাখেন অলি আহমদ।

একইভাবে জাতীয় সংসদের সাবেক স্পিকার শেখ রাজ্জাক আলী বিএনপি থেকে বেরিয়ে রাজনীতির ময়দান থেকে এখন প্রায় বিস্মৃত হওয়া এক নাম। তেমনি পরিণতির শিকার হন বিএনপি নেতা সাবেক হুইপ আশরাফ আলী।

বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালীন স্থায়ী কমিটির সদস্য নাজমুল হুদাও বিএনপি থেকে বিতাড়িত হয়ে করেছিলেন বিএনএফ। পরে নিজের গড়া দল থেকেই বহিষ্কার হন তিনি। এখন আবার নতুন দল গড়েছেন নাজমুল হুদা, যদিও নানাজনের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিএনপিতে ফেরার আগ্রহের কথাও জানিয়েছেন তিনি।

আওয়ামী লীগ, বিএনপির মতো বড় রাজনৈতিক মেরুকরণের বাইরেও এরশাদের নেতৃত্বে একটি রাজনৈতিক শক্তির জন্ম হয়েছে। সেই বলয় থেকে বেরিয়ে অনেকে বিলীন হয়ে গেছেন। সাবেক মন্ত্রী চক্ষু চিকিৎসক আবদুল মতিন পার্টি থেকে বেরিয়ে জাতীয় পার্টি (মতিন) গড়ে তোলেন।

জাতীয় পার্টি থেকে বেরিয়ে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু জাতীয় পার্টি (জেপি) করেছেন। তিনিও সুবিধা করতে পারেননি। জাতীয় পার্টি থেকে বেরিয়ে আসা আরেক অংশের নেতৃত্ব দিয়েছেন নাজিউর রহমান মঞ্জুর। তার মৃত্যুর পর তার ছেলে তরুণ ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ বাংলাদেশ জাতীয় পাটির (বিজেপি) হাল ধরেছেন। তবে রাজনীতির বলয়ে তাদের কোনো অবস্থান তৈরি হয়নি।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলের সেই নেতারা  

২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা জারির পর রাজনৈতিক দল গঠন নিষিদ্ধ থাকা অবস্থায় রাজনৈতিক দল গঠনের ঘোষণা দেন গ্রামীণ ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। জনগণের মতামত নিতে একটি পদ্ধতিও চালু করেন তিনি। তার অনুসারীরা দাবি করেন প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে বিপুল সংখ্যক মানুষ চিঠি লিখে, ই-মেইল করে বা টেলিফোনে দল গঠনের পক্ষে মত দিয়েছে। এরপর নাগরিক শক্তি নামে দল গঠনের ঘোষণা দেন ড. ইউনূস। কিন্তু পরে সুবিধা করতে না পেরে সে পথ থেকে সরে আসেন নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূস।

২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর একটি জাতীয় দৈনিকে ইউনূস নিবন্ধ লিখে বলেন, তাকে রাজনীতিতে নামাতে গাছে তুলে মই সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। কারা এই মই সরিয়ে নেওয়ার কাজ করেছে তা অবশ্য বলেননি ড. ইউনূস। আর সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমল শেষে গণতন্ত্রে ফেরার পর রাজনীতিতে নামার বিষয়টি পরোক্ষভাবেও বলেননি ড. ইউনূস।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ফেরদৌস আহমেদ কোরেশীর পিডিপি, সাবেক সেনা কর্মকর্তা সৈয়দ মোহাম্মদ ইব্রাহিমের কল্যাণ পার্টি ‘কিংস পার্টি’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল। এই নেতারা তখন এমন একটি মতধারা প্রচারের চেষ্টা করেন যেন তাই জাতিকে আলোর পথ দেখাবে। কিন্তু দেশ গণতন্ত্রে ফেরার পর হারিয়ে গেছেন এই নেতারাও। আর নিজ দল নিয়ে বিএনপি-জামায়াতের জোটে যোগ দিয়েছেন কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ মোহাম্মদ ইব্রাহিম।

নামেই বিরোধী দল জাতীয় পার্টি

গণআন্দোলনে ক্ষমতা হারানোর পরও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্রমাগত বলে আসছেন আওয়ামী লীগ-বিএনপির প্রতি বীতশ্রত হয়ে তাকেই চাইছে জনগণ। কিন্তু এরশাদের এই বক্তব্যের কোনো প্রমাণ নেই ভোটে।

১৯৯১ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তিনটি জাতীয় নির্বাচনে জাতীয় পার্টির ভোট এবং সংসদ সদস্যের সংখ্য কমেছে ধারাবাহিকভাবে। ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোটের শরিক হিসেবে উল্লেখযোগ্য সংখক আসনে জিতে আসলেও রাজনীতিতে গুরুত্ব পায়নি জাতীয় পার্টি।

আর দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির বর্জনের মুখেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জাতীয় সংসদে প্রধান বিরোধীদলের মর্যাদা পেয়েছে জাতীয় পার্টি। বিরোধী দল হয়েও সরকারের অংশ নিয়ে আলোড়ন তুলেছে দলটি। সরকারে থেকে সরকারের কোনো কর্মকা-ের বিরোধিতা করা আদৌ সম্ভব কি না সে নিয়ে কথা উঠে শুরু থেকেই।

জাতীয় পার্টির নেতারা শুরুতে বলেছেন, সরকারের অংশ নিলেও তারা সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা করবেন এবং জনগণের স্বার্থের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলে প্রতিবাদ করবেন তারা। কিন্তু এটা আদৌ হয়েছে কি না তা বলতে পারেন না জাতীয় পার্টির নেতারাই।

সম্প্রতি দলের চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ রংপুরে এক অনুষ্ঠানে দলের তিন নেতাকে মন্ত্রিসভা থেকে বের হয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, প্রকৃত বিরোধী দল হতে হলে এটা করতেই হবে তিন মন্ত্রীকে। কিন্তু এরশাদের এই আহ্বানকে পাত্তাও দেননি তিন মন্ত্রী। আর সংসদে বিরোধী দল হলেও রাজনৈতিক ময়দানে এই মর্যাদা পায়নি জাতীয় পার্টি। বরং সরকারের সহযোগী হিসেবেই দলটিকে দেখা হয়।

সদ্যসমাপ্ত তিন সিটি নির্বাচনে মেয়র পদে প্রার্থী দিলেও কোনো প্রার্থীই তাদের জামানত রক্ষা করতে পারেননি। বরং এক শতাংশেরও কম ভোট পেয়ে জাতীয় পার্টির অবস্থান যে ভোটারদের মধ্যে তলানীতে তার প্রমাণই যেন রেখেছেন তিন নেতা।

আশা পূর্ণ হলো না জামায়াতের

মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে পাকিস্তানের হয়ে অস্ত্র ধরার দায়ে মুক্তিযুদ্ধের পর নিষিদ্ধ হয় জামায়াত। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পক্ষে কেবল অস্ত্র ধরা হয়, গণহত্যায় পাকিস্তানি বাহিনীকে পরামর্শ দেওয়া, রাজাকার-আলবদর বাহিনী গঠনসহ নানা নৃশংসতায় যোগ দিয়েছে জামায়াত কর্মীরা। যুদ্ধের পর জনরোষের ভয়ে আত্মগোপনে থাকা জামায়াত নেতারা প্রকাশ্যে ফেরেন ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর।

জিয়াউর রহমানের শাসনামলে মাকে দেখতে এসে নাগরিকত্ব হারানো জামায়াত নেতা গোলাম আযম বাংলাদেশে ফেরেন। রাজনৈতিক দল হিসেবেও আবার কাজ শুরু করে জামায়াত। আর ১৯৮৬ সাল থেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও অংশ নেয় জামায়াত। ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে প্রায় ১২ শতাংশ ভোট এবং ১৭টি আসন পায় স্বাধীনতাবিরোধী দলটি। ১৯৯৬ সালের জাতীয় নির্বাচনে তাদের ভোট চার শতাংশ এবং আসন ১৪টি কমে আসলেও ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে বিএনপির সঙ্গে জোট বেঁধে প্রথমবারের মতো রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার স্বাদ নেয় জামায়াত। দেশের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরার দায়ে জামায়াতের বিচারের জোরাল দাবির মধ্যে দুই আলবদর নেতার গাড়িতে জাতীয় পতাকা দেখে ফুঁসে উঠে জনগণ। তবে এসবকে পাত্তা না দিয়ে জামায়াত নেতারা স্বপ্ন দেখে আসছিলেন, তারা ধীরে ধীরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে বড় শক্তি হিসেবে আবির্ভাব করবে এবং এর এক পর্যায়ে এককভাবে ক্ষমতা নেবে জামায়াত।

কিন্তু দলটির সে স্বপ্ন এখন বলতে গেলে ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দলের দুই নেতার ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। ট্রাইব্যুনালে ফাঁসির রায় হয়েছে আরও চার নেতার বিরুদ্ধে। দ- কার্যকর হলে দেশে গৃহযুদ্ধ হবেÑএমন হুঁশিয়ারি দিলেও এখন মাঠেই নামতে পারছে না জামায়াত কর্মীরা। জামায়াতের সাংগঠনিক ক্ষমতা এবং কর্মীদের আন্দোলনের ক্ষমতা নিয়ে রাজনীতিতে অতিশয়োক্তি হতো। কিন্তু এই পথম বিরুদ্ধ পরিবেশে দেখা গেছে, জামায়াতের কথিত শক্তি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সত্য নয়। জামায়াত আসলে কাগুজে বাঘ কি না সে কথাও হচ্ছে এখন।

বারবার ভেঙে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হয়েছে বাম দল

বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলনে বাম নেতাদের অবদানও অনস্বীকার্য। বেশ শক্তিশালী একটি বাম রাজনৈতিক ধারা এ দেশে পাকিস্তান আন্দোলনের শুরু থেকেই ছিল। কিন্তু এই ধারা আলোচিত নেতা তৈরি করতে পারলেও জনগণের মধ্যে বিকশিত হতে পারেনি তেমন। স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই, বৈষম্যমুক্ত সমাজ গঠন, দুর্নীতি নির্মূলের মতো জনপ্রিয় নানা বিষয় নিয়ে কথা বললেও ভোটের ময়দানে এই ধারার দল এবং নেতাদের অবস্থান গুরুত্ব হারাচ্ছে দিনদিন। বিভিন্ন ধারায় বিভক্ত বামশক্তিগুলো বিশেষ করে গত শতকের আশির দশকের শেষে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর বাংলাদেশের রাজনীতিতেও গণমাধ্যমেই কেবল অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে।

স্বাধীনতার চার দশকে এই দলের ডাকসাইটে বেশ কিছু নেতা তাদের রাজনৈতিক বিশ্বাস পাল্টে কেউ আওয়ামী লীগ, কেউ বিএনপি, ক্ষমতায় থাকা জাতীয় পার্টি বা আরও রক্ষণশীল দল এমনজি স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতের সঙ্গেও হাত মিলিয়েছেন।

আবার আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দ্বিদলীয় মেরুকরণের বাইরে আলাদা শক্তি গড়ার কথা বলে একটি ধারাও চলছে যারা গণমাধ্যমে আলোচনায় এলেও জনগণের মধ্যে তেমন আলোড়ন তুলতে পারছে না। নানা ঘটনায় বাম দলগুলো ভেঙে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হচ্ছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনৈতিক লক্ষ্য স্থির করতে না পারা, নেতৃত্বের বিরোধ-অনৈক্য, আর্থিক টানাপড়েন আর অভ্যন্তরীণ নানা সংকটে বিপর্যস্ত এসব দল। এ কারণেই কাঙ্খিত লক্ষ পূরণ না হয়ে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হচ্ছে এসব দল।

বাম ঘরানার রাজনৈতিক দলগুলোর একটি বড় অংশ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের শরিক। এদের মধ্যে আবার দুটি দল আছে সরকারে। বাকিরা বঞ্চিত হয়ে হতাশ। চৌদ্দ দলীয় জোটের বাইরে দ্বিদলীয় মেরুকরণের বিরুদ্ধে জনমত গড়তে রাজপথে আছে আটটি বাম রাজনৈতিক দলের জোট ‘গণতান্ত্রিক বাম মোর্চা’। প্রায় অভিন্ন লক্ষ্য নিয়ে কিছুদিন ধরে একসঙ্গে পথ চলছে কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) এবং বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)।

৫ জানুয়ারি নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতা গ্রহণ করলে ১৪ দলীয় জোটের দুই শরিক ওয়ার্কার্স পার্টি ও সমাজতান্ত্রিক দলের দুই শীর্ষ নেতা রাশেদ খান মেনন এবং হাসানুল হক ইনুকে মন্ত্রী করা হয়। অন্যদিকে রাশেদ খান মেনন মন্ত্রিসভায় যোগ দেওয়ার পর এ নিয়ে দলের ভেতর শুরু হয় মতবিরোধ।

১৪ দলের আরেক শরিক সাম্যবাদী দল (এমএল)। এই দলের শীর্ষ নেতা দিলীপ বড়–য়া আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের শিল্পমন্ত্রী ছিলেন। তার সঙ্গে দ্বন্দ্বের কারণে সাম্যবাদী দলের (এমএল) একাংশের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক সাঈদ আহমেদের নেতৃত্বে ২০দলীয় জোটে যোগ দেয়।।

১৪ দলের শরিক ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ- মোজাফফর), গণতন্ত্রী পার্টি, কমিউনিস্ট কেন্দ্র, গণআজাদী লীগ, গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টি ও বাসদের একটি অংশ আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটে থাকলেও সরকারে নেই।

দেশের প্রধান দুটি বাম ঘরানার রাজনৈতিক দল সিপিবি ও বাসদ। তারাও জোট-মহাজোট এই দ্বিদলীয় মেরুকরণের বাইরে স্বতন্ত্র অবস্থা বজায় রেখে বাম বিকল্প শক্তি হিসেবে নিজেদের অবস্থান গড়ে তুলে তা সুসংহত করার জন্য বেশ কিছুদিন ধরে চেষ্টা চালাচ্ছে। সিপিবির অভ্যন্তরীণ সংকট তেমন না থাকলেও সম্প্রতি বাসদ থেকে একটি অংশ বেরিয়ে গেছে। তারা প্রায় একই নাম নিয়ে সম্পৃক্ত হয়েছে গণতান্ত্রিক বাম মোর্চার সঙ্গে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির নেতা রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, দুই দলের কারণে মানুষ অনেকটাই মনস্তাত্ত্বিক চাপে আছে। রাজনৈতিকভাবে তাদের শিক্ষিত করার কোনো উদ্যোগ নেই বলে বিকল্প নিয়েও সেভাবে ভাবতে পারেন না।

প্রিন্স বলেন, বামপন্থি ও প্রগতিশীলরা এক মঞ্চে আসতে না পারাও বিকল্প শক্তি গড়ে না উঠার অন্যতম কারণ এ কারণে দ্বিদলীয় ধারা আরও দীর্ঘ হচ্ছে।

আম আদমি পার্টির ধাঁচে আম জনতার দলের খবর নেই

২০১৪ সালে ভারতের দিল্লি বিধানসভার নির্বাচনে আলোড়ন তৈরি করে নবগঠিত রাজনৈতিক দল আম আদমি পার্টি। নিপীড়িত মানুষের ক্ষমতায়নের ডাক দিয়ে সাবেক সরকারি কর্মকর্তা অরবিন্দ কেজরিওয়ালের নেতৃত্বে দলটি কংগ্রেস এবং বিজেপিকে ধরাশায়ী করে রাজধানীর মসনদ দখল করে।

আম আদমি পার্টির এই সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে বাংলাদেশেও এই দলের নাম অনুকরণ করে গঠিত হয় আম জনতার দল। ২০১৪ সালের ১৭ জানুয়ারি সংবাদ সম্মেলন করে দলের আত্মপ্রকাশের ঘোষণা দেন পরিবেশবাদী হিসেবে পরিচিত ইনামুল হক। তার সঙ্গে ছিলেন জাতীয় তেল-গ্যাস ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ। ওই সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনা ও দায়িত্ববোধের তাড়নায় বাংলাদেশের নতুন দল গঠন করেছেন তারা। বাংলাদেশের বিবেকবান, প্রতারিত ও নিপীড়িত নাগরিকদের এই দলে যোগ দেওয়ার আহ্বানও জানানো হয় সেদিন।

আম জনতার দলের নেতাদের আশা ছিল, ভারতে যদি আম আদমি পার্টি হঠাৎ এসে সব জয় করতে পারে, তাহলে পাশের দেশ বাংলাদেশেও এমনটি হতে পারে সহজেই।

কিন্তু পরের দেড় বছরের কাহিনি পুরো হতাশার নতুন এই দলের জন্য। তেমন সাড়া না পেয়ে এই দলের উদ্যোক্তা ইনামুল হক এখন আর এ বিষয়ে কোনো কথাই বলেন না।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা যা বলছেন

দুই প্রধান দল আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির বাইরে কোনো রাজনৈতিক শক্তির প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আসলেই কি কোনো  পরিবেশ বা সম্ভাবনা আছে? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক গোবিন্দ্র চক্রবর্তী মনে করেন কোনো কোনো গণমাধ্যম যতই এ নিয়ে প্রচার করুক, তৃতীয় শক্তির কোনো সম্ভাবনা বাংলাদেশে নেই। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের রাজনীতিতে যারা তৃতীয় শক্তির কথা বলে আমার মনে হয় তারা দেশের রাজনীতি বুঝে না। দেশের বড় দুই জোটের মধ্যে যখন বিভিন্ন সংকট সৃষ্টি হয় তখনই কিছু সুবিধাবাদী সুশীল সমাজ এবং বামপন্থিরা এই তৃতীয় শক্তির কথা বলে। আবার যখন সংকট সহনীয় পর্যায়ে চলে আসে তখনই তাদের এমন কথা বন্ধ হয়ে যায়।’

এই বাস্তবতাতেও বারবার কেন তৃতীয় শক্তির নাম আসে? গোবিন্দ চক্রবর্তী বলেন, ‘কিছু বামপন্থি নেতা আছেন, যাদের জনপ্রিয় হওয়ার খায়েশ থাকলেও বাস্তবতা বোঝেন না তারা। এক স্বপ্ন থেকেই এসব কথা বলেন তারা।’ এই রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বলেন, ‘এই দুই দলের বাইরে কোনো শক্তি আসতে পারবে না সেটা আমি বলব না। তবে এর জন্য সব দলকেই জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে।’

রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘বাংলাদেশে তৃতীয় শক্তি আসবে কি না সেটা জনগণের তৎপরতার ওপর নির্ভর করবে। আর তৃতীয় শক্তি এলেই যে আমাদের সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে তেমনও না, কারণ আমরা অতীতে দেখেছি তৃতীয় শক্তি আসার পর সমস্যা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে।’

দেশের চলমান সমস্যা সমাধান প্রসঙ্গে এ রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলেন, ‘বিদ্যমান সমস্যা সমাধান করতে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে। রাজনৈতিক দলের মধ্যে গণতান্ত্রিক চর্চা আরো বাড়াতে হবে। এছাড়াও যেটা দরকার সেটি হলো রাজনৈতিক দলসমূহের মধ্যে পারস্পরিক গণতান্ত্রিক সম্পর্ক আরো বাড়াতে হবে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর