বিন্না ঘাসে বাংলার জয়

ভিয়েতনামের ডানাংয়ে হয়ে গেল ষষ্ঠ আন্তর্জাতিক ভেটিভার সম্মেলন। ড. মুহাম্মদ শরীফুল ইসলাম দুটি পুরস্কার এনেছেন এ সম্মেলন থেকে। একটি ‘দ্য কিং অব থাইল্যান্ড ভেটিভার অ্যাওয়ার্ড ২০১৫’। অন্যটি ‘দ্য ভেটিভার নেটওয়ার্ক ইন্টারন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড ২০১৫’। থাইল্যান্ডের রাজকন্যা চকোরি শ্রীনিধন সে দেশের রাজার পক্ষ থেকে দুটো পুরস্কারই ইসলামের হাতে তুলে দেন। এর আগেও তিনি বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সম্মেলনে সম্মান ও সম্মাননা অর্জন করেছেন। ভেটিভার বা বিন্নাঘাস নিয়ে তাঁর গবেষণা এখন বলতে গেলে একটি আন্দোলন।

ইস্পাতের মতো শক্তিশালী

নদীর পার, পাহাড়ি ঢাল, গ্রামের রাস্তা ও মহাসড়ক এবং সমুদ্রতীরবর্তী এলাকায় বিন্নাঘাসের আবাদ ও ব্যবহারে ভাঙন রোধ হয়। এটি আবার সুগন্ধিও। তাই প্রসাধনীসহ অনেক জিনিসের কাঁচামাল হিসেবে বিন্না ঘাস ব্যবহৃত হচ্ছে অনেক দেশে। আমাদের দেশে একে অনেকে খসখস নামেও ডাকে। এ ঘাসটির রাসায়নিক গুণাগুণ এবং উন্নয়নকাজের ব্যবহারযোগ্যতা নিয়ে অনেক দিন ধরেই বুয়েটে গবেষণা চলছে। বিন্না ঘাসের মূল মাটির গভীরে চলে গিয়ে মাটিকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে। বিশেষত উষ্ণ আবহাওয়ার দেশে আর সব উদ্ভিদের চেয়ে এর মূল বেশি কাজে দেয়। লম্বা শিকড় অল্প দিনেই মাটির নিচে জালের মতো ছড়িয়ে পড়ে। অনেক সময় এ শিকড় চলে যায় ১০ থেকে ১৪ ফুট গভীরে। চার থেকে ছয় মাসের মধ্যে মাটিতে বোনা ঘাস ঢাল রক্ষার জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়। হিম ঠাণ্ডা কিংবা খরতাপ-সব পরিবেশে মানিয়ে নেওয়ার অদ্ভুত ক্ষমতা আছে এ ঘাসের। মাইনাস ১৫ থেকে ৫৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়ও বেঁচে থাকতে পারে। আবার অনাবৃষ্টিতে নেতিয়ে পড়ে না, পানিতে ডুবে থাকলেও পচে যায় না। আগুন, পোকামাকড় ও রোগের প্রকোপ থেকে রেহাই পাওয়ার ক্ষমতা একে প্রকৃতিই দিয়েছে। আর লবণাক্ততায় টিকে থাকতে পারে বলে সমুদ্রতীরের এলাকায় বাঁধ রক্ষায় ভেটিভার সহজেই ব্যবহার করা যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, এ ঘাসের একটা শিকড়ের সহনশক্তি ইস্পাতের ছয় ভাগের এক ভাগ! অর্থাৎ ছয়টা শিকড় একসঙ্গে করলে এটি ইস্পাতের মতোই শক্তিশালী।

বিন্না ঘাসে বাংলার জয়দ্য কিং অব থাইল্যান্ড ভেটিভার অ্যাওয়ার্ড ২০১৫

অনেক কাজের কাজি

প্রাচীন তামিল পুঁথিতে ঘাসটির ঔষধি গুণের কথা বলা আছে। কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের ‘বাদশাহ নামদার’ বইতে খসখসের শরবত পানের উল্লেখ আছে। জনপ্রিয় পানীয় রুহ আফজার একটি উপাদানও বিন্না ঘাস। ভেটিভারের নির্যাসযুক্ত চা খায় অনেক দেশের লোক। আজও এশিয়া ও আফ্রিকার কিছু এলাকায় ভেষজ ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয় খসখস। ভারতে ব্যবহৃত হয় ঘর ঠাণ্ডা রাখার উদ্দেশ্যে। একটি রকম এমন-ভেটিভারের শিকড় দিয়ে মাদুর বানিয়ে গ্রীষ্মকালে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় সদর দরজায়। নিয়মিত বিরতিতে পানি ছিটিয়ে মাদুরটি ভিজিয়ে রাখা হয়। বাতাস বইলে ঘর তো ঠাণ্ডা হয়ই, সেই সঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে সুগন্ধ। এ ছাড়া ভেটিভার কাগজ ও পার্টিক্যাল বোর্ড তৈরির কাঁচামাল। এর শক্ত শিকড় দড়ি, টুপি, ঝুড়ি, মাদুর, চেয়ারেও লাগে। আবার জৈব সার তৈরিতেও ব্যবহৃত হয়। বিন্না ঘাস একদিকে যেমন গবাদি পশুর খাদ্য, আবার এর পাতা দিয়ে জুতা, ব্যাগ, ঘরের চালা, ট্রে, কুশন ও বালিশের কভার, বিছানার চাদর, শৌখিন কার্ড, টেবিলের রানারসহ অনেক আকর্ষণীয় হস্তশিল্প বানানো হয় বাণিজ্যিকভাবে। ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, ভারত, থাইল্যান্ডসহ বেশ কিছু দেশ ভেটিভার দিয়ে বানানো সামগ্রী রপ্তানিও করছে।

ভেটিভারের আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক

বিশ্বজুড়ে টেকসই পরিবেশ গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে ‘দ্য ভেটিভার ইন্টারন্যাশনাল নেটওয়ার্ক’। ভেটিভারের সবুজ প্রযুক্তির সাহায্যে মাটির ক্ষয়রোধ, মাটি ও পানি দূষণ দূরীকরণ, কৃষিজমির গুণগত মান বৃদ্ধি, রেললাইন, নদী ও সমুদ্রতীরের ঢালের সুরক্ষা প্রদান, দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি কমানো, ভেটিভারের চাষ ও তা থেকে নানা হস্তশিল্প তৈরির কাজ করে চলেছে এ নেটওয়ার্ক। সেই সঙ্গে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবিকা আহরণের উপায়ও খুঁজে দিচ্ছে। এশিয়া, আফ্রিকার গণ্ডি পেরিয়ে ভেটিভারের জনপ্রিয়তা আর প্রয়োগ পৌঁছে গেছে ইউরোপ ও আমেরিকার উন্নত দেশগুলোতেও। বিশ্বের নানা প্রান্তে ভেটিভারের গুণাগুণ আর প্রয়োগ নিয়ে যেসব গবেষণা চলছে, তার হালনাগাদ পাওয়া যায় নেটওয়ার্কের www.vetiver.org ওয়েব সাইটে। বিশ্বব্যাপী ভেটিভার গবেষকদের একই ছাদের নিচে নিয়ে আসার লক্ষ্যে এ নেটওয়ার্ক ১৯৯৬ সাল থেকে আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজন করছে। চার বছর পর পর এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।

একজন ড. মুহাম্মদ শরীফুল ইসলাম

জাপানের সাইতামা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের পর সেখানে আরো দুই বছর ছিলেন পোস্ট ডক্টরাল রিসার্চ করতে। এর আগে বুয়েটে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জনের সময় ভালো ফলাফলের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ‘ড. রশিদ গোল্ড মেডেল’ এবং ‘শরফুদ্দিন গোল্ড মেডেল’ লাভ করেন। তিনি ২০১২ সালে মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত সপ্তম সিইউটিএসই সম্মেলনে ‘বেস্ট পেপার অ্যাওয়ার্ড ইন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং’, বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত আইসিইটিসিইএসডি ২০১১-তে ‘ফার্স্ট প্রাইজ’, ২০০৮ সালে ভারতে অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ এশিয়ান ইয়ং জিওটেকনিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার্স কনফারেন্সে ‘সার্টিফিকেট অ্যাপ্রিসিয়েশন’, ২০০৪ সালে তাইওয়ানে অনুষ্ঠিত পঞ্চম এশিয়ান ইয়ং জিওটেকনিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার্স কনফারেন্সে ‘বেস্ট পেপার অ্যাওয়ার্ড’, ২০০১ সালে জাপান সোসাইটি অব সিভিল ইঞ্জিনিয়ার্সের ৫৬তম বার্ষিক সম্মেলনে ‘এক্সিলেন্ট প্রেজেন্টেশন অ্যাওয়ার্ড’ লাভ করেন। ব্যক্তিগত জীবনে শরীফুল ইসলাম এক কন্যাসন্তানের জনক।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর