ভেজালের বিরুদ্ধে মনুষ্যত্বের জাগরণ

হাওর বার্তা ডেস্কঃ মানুষের মৌলিক অধিকারের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল হলো খাদ্য। দৈনন্দিন জীবনে বেঁচে থাকার জন্য আমাদের শাকসবজি ও ফলমূল কমবেশি খেতে হয়। পুষ্টিবিদ এবং ডাক্তাররা আমাদের সুস্থ থাকার জন্য বেশি বেশি শাকসবজি এবং ফলমূল খেতে পরামর্শ দেন। কিন্তু বাজারের শাকসবজি ও ফলমূল কি নিরাপদ? ভেজাল খাদ্যের পরিমাণ এত বেড়ে গেছে যে তৈরি অথবা কাঁচা, কোনো খাদ্যদ্রব্যের ওপরই আর আস্থা রাখা যাচ্ছে না। আমাদের দেশে বিচিত্রভাবে খাদ্যে ভেজাল মেশানো হয়।

কীটপতঙ্গের আক্রমণ থেকে শাকসবজিকে রক্ষা করার জন্য ব্যবহার করা হয় কীটনাশক এবং ফলকে পাকানো ও পচন রোধকল্পে ব্যবহার করা হচ্ছে ক্যালসিয়াম কার্বাইড, ফরমালিন এবং বিভিন্ন ক্ষতিকারক কেমিক্যাল। তাই ফলের মৌসুম শুরু হওয়ার আগেই বাজারে মিলছে ভেজাল উপায়ে সংরক্ষণ করা সেসব ফল। এমনকি বারোমাসি ফল পেঁপে, কলাও নিরাপদ নয়। বাজার থেকে শাকসবজি, ফলমূল, মাছ, মাংস, চাল, ডাল, সেমাই, দুধ, চিনি বা আপনার পছন্দের জিনিসটি কিনবেন? আপনি নিশ্চিত হতে পারবেন না যা কিনেছেন তা খাঁটি না ভেজাল। কারণ মেয়াদোত্তীর্ণ, ভেজাল ও ক্ষতিকর এসব পণ্যে বাজার সয়লাব হয়ে গেছে।

নিউমার্কেট কাঁচাবাজারে মেয়াদোত্তীর্ণ বাসি ও শুকিয়ে যাওয়া মাংস ফ্রিজে রেখে রক্তবর্ণের বিষাক্ত রাসায়নিক রং ক্ষণে ক্ষণে মাংসে লেপ্টে দিয়ে তা টাটকা ও তাজা বলে বিক্রি করা হচ্ছে। র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম বলেন, ব্যবসায়ীদের এমন প্রতারণা ক্রেতারা বুঝতেই পারবে না। এই বিষাক্ত রং মেশানো মাংস কিনে প্রতারিত হচ্ছেন ভোক্তারা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি অনুষদের সাবেক ডিন, ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আ ব ম ফারুক বলেন, ১৯টি টেক্সটাইলের ক্ষতিকর রং খাদ্যে ব্যবহার করা হচ্ছে। এ কারণে ক্যান্সার ও কিডনি রোগ বাড়ছে এবং শিশুরা পড়ালেখায় অমনোযোগী হচ্ছে।

বিএসটিআই বাজার থেকে প্রায় ৪০৬টি পণ্য ক্রয় করে তাদের নিজস্ব ল্যাবে পরীক্ষা করে, তার মধ্যে ৫২টি পণ্য ভেজাল বা মানসম্মত নয়। এগুলোর মধ্যে- সরিষার তেল, ঘি, চিপস, খাবার পানি, মসলা, নুডলস, চানাচুর, এমনকি আয়োডিনযুক্ত লবণও রয়েছে। অথচ বাজারের অনেক দ্রব্য বা পণ্যের গায়ে বা বিজ্ঞাপনে ‘খাঁটি’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়। খাঁটি সরিষার তেল, খাঁটি নারিকেল তেল, খাঁটি দুধ, খাঁটি মধু, আসল গরুর মাংস (মহিষের নয়), আসল খাসির মাংস (ভেড়ার নয়)-এসব কথা শুনতে শুনতে আমরা এখন আসল আর ভেজাল চিনতে ব্যর্থ হচ্ছি।

এক-শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী দেশে আমদানি করছে হিমায়িত মহিষ, ভেড়া ও দুম্বার মাংস, যার বড় অংশ মেয়াদোত্তীর্ণ। অন্যদিকে বৈধ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে আমদানি করা দুম্বা ও ভেড়ার মাংস দেশে ঢুকেই হয়ে যাচ্ছে খাসি, মহিষ অথবা গরুর মাংস। মেয়াদোত্তীর্ণ এবং নাম পরিবর্তিত মাংস ঢাকার বিভিন্ন পাঁচ তারকা হোটেল, সুপারশপ থেকে শুরু করে দেশের রাজধানী, উপশহরগুলোতে বিক্রয় হচ্ছে। এমনকি আমদানি করা মাংসগুলো জীবাণুমুক্ত কি না, তাও যাচাই করা হচ্ছে না। কিছুদিন আগে রাজধানীর তেজগাঁও এলাকার একটি হিমাগার থেকে বিপুল পরিমাণ মেয়াদোত্তীর্ণ দুম্বা ও মহিষের মাংস, খেজুর, কিশমিশ, আচার, চিপস, মাখন এবং টুনা, রূপচাঁদা ও চিংড়ি মাছ জব্দ করা হয়। ওইসব খাদ্য বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানিকৃত যেগুলোর মেয়াদ বহু আগেই শেষ হয়ে গেছে।

হাইকোর্টে দাখিল করা এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, প্রায় ৯৬টি দুধের নমুনার মধ্যে ৯৩টিতেই রয়েছে ভেজাল। যাতে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া সিসা এবং অ্যান্টিবায়োটিকের রয়েছে সরব উপস্থিতি। এমনকি দুগ্ধজাত পণ্য দই বা ঘিও এর প্রকোপ থেকে মুক্ত নয়। যা খেলে আমাদের সুস্থ থাকার বদলে অসুস্থই থাকতে হবে বেশি। মুরব্বিরা বলেন, প্রতিদিন এক গ্লাস দুধ খেলে ডাক্তারের কাছে যাওয়া লাগে না। কিন্তু এই দুধের মধ্যেও বিষ। তবে সবকিছু যে কৃত্রিম উপায়ে হয় তাই নয়।

প্রাণিকুলের ফুড চেইনের কারণেও দুধে কিছু ভারী ধাতুর অস্তিত্ব লক্ষ করা যায়। কারণ গরু যে ঘাস খায় সেখানে ভেজাল, পানিতে ভেজাল, লবণে ভেজাল, বাজারজাতে প্রস্তুতকৃত গো-খাদ্যে ভেজাল, গরু মোটাতাজাকরণে ব্যবহৃত হয় ক্ষতিকর অ্যান্টিবায়োটিক, মুরগিতে ভেজাল, ডিমে ভেজাল, মাছে ভেজাল, সব পণ্যে ভেজাল। কাজেই এসব ভেজালের ক্ষতিকর প্রভাব কোনো না কোনোভাবে গরুতে পড়ছে। সেই সঙ্গে পড়ছে গোমাংস ও দুধের ওপর। আর চূড়ান্তভাবে তা তো মানুষ নামক গিনিপিগের শরীরের ওপরই ভর করছে। আর তাই এখন পেটের পীড়াসহ ক্যান্সারের মতো মরণব্যাধি ছড়িয়ে পড়ছে মানুষের শরীরে।

শিশুরা হচ্ছে সমাজের ফুল। তারা যদি ছোটবেলা থেকেই এসব ভেজাল দুধ এবং ভেজাল খাবার খেয়ে অসুস্থতার মাঝে বেড়ে ওঠে তাহলে এই সমাজের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেবে কারা? আমরা কি বাগানের ফুলগুলো অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে দিচ্ছি না? শাকসবজি ও ফলমূলে ব্যবহৃত কীটনাশক সবরকম বিষাক্ত রাসায়নিকের প্রভাবে শিশুরা বেশি আক্রান্ত হয়। এ ছাড়া মাছ, মাংস উৎপাদনে ব্যবহার করা হচ্ছে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিবায়োটিক, যা মানবদেহে প্রবেশের মাধ্যমে সৃষ্টি হচ্ছে সুপারবাগ। ধীরে ধীরে মানুষের শরীরের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে শরীর অ্যান্টিবায়োটিক রেসিসট্যান্স হয়ে যাচ্ছে। ফলে শিশু কিশোর বৃদ্ধ কারও শরীরেই কাজ করছে না কোনো অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ এবং সামান্য সর্দি-কাশিতেও মৃত্যু হচ্ছে মানুষের।

ভেজাল খাদ্য রাষ্ট্রের জন্য রাসায়নিক অস্ত্র ও আণবিক বোমার চাইতেও ভয়ঙ্কর ধ্বংসাত্মক এক মারণাস্ত্র। এই ভেজাল খাদ্য জাতিকে নিঃশেষ ও নিস্তেজ করে ফেলছে। খাদ্যে যারা ভেজাল মেশায় তাদের মধ্যে কোনো মানবিক বোধ নেই, সহমর্মিতা নেই। তারা কেবল বোঝেন লাভ আর লোভের প্রাচুর্য ও ভোগবিলাস। কেবল শাস্তি আর জরিমানা করে এ সমস্যার সমাধান করা যাবে না। মানুষের মাঝে মনুষ্যত্ববোধ তৈরির জন্য সুষ্ঠু সামাজিকীকরণের দিকে মন দিতে হবে। পারিবারিক অনুশাসনের দিকে জোর দিতে হবে। ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রসার ঘটাতে হবে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ভেজালের মাধ্যমে যারা অন্যের মানবাধিকার তথা জীবনকে বিপন্ন করে, তাদের কঠোর হস্তে দমন করতে হবে। সর্বোপরি বিবেক নামক অন্তর্নিহিত আদালতকে ক্রিয়াশীল করতে হবে। মনে রাখা উচিত, অসুস্থ হওয়াটা এক বিরাট অভিশাপ। সুস্বাস্থ্যই সব সুখের মূল।

আমাদের সমাজ দিন দিন কেমন যেন দুর্বিনীত, বর্বর হয়ে উঠছে। এটি কোনো শুভ লক্ষণ নয়। বৈধ, নিষ্ঠা, বিনয়, উদারতা, কল্যাণবোধ, মমত্ববোধ মানব সমাজের অন্যতম ভিত্তি। এই গুণগুলো আছে বলেই সমাজব্যবস্থা এখনো টিকে আছে। এসব গুণ এখন যে নেই তা নয়, তবে ভিত দুর্বল হয়ে গেছে। এ জন্য অসৌজন্যবোধ, নীতিহীনতা, দুর্নীতি ঘটেই চলছে। এসব ব্যাধি থেকে সমাজকে রক্ষা করতে মূল্যবোধের চর্চা, ধর্মীয় সুশিক্ষা, সুস্থ সাংস্কৃতিক চর্চার বিকল্প নেই। এগুলো মানুষের মনকে সুন্দর করে হিংসা-বিদ্বেষ দূর করে, কর্তব্যপরায়ণতা, নিষ্ঠা, ধৈর্য, উদারতা, শিষ্টাচার, সৌজন্যবোধ, নিয়মানুবর্তিতা, দেশপ্রেম তৈরি করে। সমাজকে প্রজন্ম পরম্পরায় অবক্ষয়ের হাত থেকে বাঁচায়। এতে অপরাধের মাত্রাও কম থাকে, গড়ে ওঠে মানবিক সমাজ।

জগতে আমাদের যা প্রয়োজন তা শুধু সম্পদ সৃষ্টি নয়। আমাদের ভালো থাকার ব্যবস্থা করাও প্রয়োজন। সম্পদ হলো ভালো থাকার উপযোগী একটি যন্ত্রাংশ মাত্র, গোটা যন্ত্রটা নয়। কিন্তু এই মুহূর্তে মানুষ সম্পদের পেছনে এমনভাবে ছুটছে, যেন সেটা একটা ধর্ম। অর্থকে আমরা ভগবান করে তুলছি আর তার পেছনে অবিরাম ছুটে চলছি। অর্থ আসলে একটি উপায় মাত্র, শেষ কথা নয়। একে আমরা সৃষ্টি করেছিলাম আমাদের কিছু সুবিধার জন্য কিন্তু সম্পদের পেছনে ছুটতে গিয়ে আমরা আমাদের গ্রহটাই ধ্বংস করে ফেলছি। অথচ সম্পদ সৃষ্টির কথা ভাবার বদলে আমরা যদি মানবকল্যাণ সৃষ্টির কথা ভাবি তাহলে আমরা যা কিছু প্রয়োজন, যত দূর প্রয়োজন তার সবই করে ফেলতে পারি।

ভেজালের এই সংকট থেকে মুক্তি পেতে হলে ভোক্তাকেও সতর্কাবস্থানে থাকতে হবে। নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। এ সম্পর্কে ধারণার অভাবে প্রতারিত হওয়ার ঘটনা দিন দিন বেড়ে চলছে। খাদ্যে ভেজাল দিয়ে যারা মানুষকে মৃত্যুমুখে ঠেলে দেয় তারা হত্যাকারীর শামিল। খাদ্যে ভেজালকারীরা হচ্ছেন নীরব খুনি। তারা দেশ, জাতি ও সমাজের শক্র। তাদের এসব অসাধু কারবারের কারণে নীরবে খুন হচ্ছে সমাজের হাজারো মানুষ। কোনো ব্যক্তিকে বিষপ্রয়োগ করে হত্যা করা হলে তা ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য করে ৩০২ ধারায় হত্যামামলা করা হয়। তাহলে যারা মানুষরূপী নরপিশাচ খাবারে ভেজাল দিয়ে কোটি কোটি মানুষকে হত্যা করছে তাদের কেন মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে না?

সরকারের তরফ থেকে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউট (বিএসটিআই) কিংবা জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের মতো সংস্থা সৃষ্টি করে দেওয়া হয়েছে। তারা সারা বছরই খাদ্যে ভেজালের বিষয়ে তৎপরতা চালানোর কথা। কিন্তু রমজান এলেই ভেজালের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো ট্র্যাডিশন হয়ে গেছে। এটা কেন হচ্ছে? দায়িত্বশীলদের ঠেলাঠেলি, দোষ চাপাচাপির মানসিকতা থেকে বেরিয়ে স্বীয় কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার অভ্যাস করতে হবে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর