হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধের টাকা দিয়ে তৈরি করছে শহর রক্ষার বাঁধ

হাওর বার্তা ডেস্কঃ সুনামগঞ্জ সদর উপজেলা প্রশাসন হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধের টাকায় তৈরি করছে শহর রক্ষা বাঁধ। এভাবে কৃষকের স্বার্থের টাকা ভিন্ন কাজে ব্যবহার করা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা গেছে, গত বছর হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধের কাজে নানা অনিয়মের কারণে কাজের বিনিময়ে টাকা (কাবিটা) নীতিমালা বদলায় পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়। হাওর এলাকায় বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ মেরামত, নদী-খাল পুনঃখননের জন্য স্কিম প্রস্তুত ও বাস্তবায়নের লক্ষ্যে’ কাবিটা নীতিমালা ২০১৭ প্রণয়ন করে।

নতুন এই নীতিমালায় জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) ফসল রক্ষা বাঁধের কাজে সভাপতি করা হয়েছে। তাঁরা উপজেলা পর্যায়ে সভা করে প্রকল্প গ্রহণ ও অনুমোদন করিয়েছেন। জেলায় এ পর্যন্ত এক হাজারটি প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) গঠন করা হয়েছে। প্রায় ১০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ইউএনওদের মাধ্যমে হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধ কার্যক্রম বাস্তবায়ন হচ্ছে। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ইউএনওদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে বরাদ্দের টাকা পাঠিয়েছে।

২০১৪ সালের জলবায়ু তহবিলের টাকায় ‘জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার আওতাধীন নদীর বাঁ তীরে ধারারগাঁও-নবীনগর-হালুয়ারঘাট তীর সংরক্ষণ প্রকল্প’ চলছে। এর ব্যয় দুই কোটি ৫২ লাখ টাকা। সদর উপজেলায় এর অবস্থান হলেও নবীনগর মূলত সুনামগঞ্জ পৌর এলাকা। পাকা এই সড়কটি দিয়ে চার ইউনিয়নের মানুষ যাতায়াত করে। এ বছর হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধের টাকায় প্রায় ৪০ লাখ টাকা ব্যয়ে দুটি প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।

দেখার হাওর উপপ্রকল্পের দশমিক ৭৩৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের সুরমা ভেলি পার্কসংলগ্ন ডুবন্ত বাঁধের সেতু বন্ধকরণ ও বিকল্প বাঁধ নির্মাণ’ প্রকল্পে ১৩ লাখ ৫১ হাজার ৪৭৩ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এর পাশাপাশি পূর্বাংশে একই হাওরের ফসল রক্ষার কথা বলে ২ দশমিক ৬১৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের বাঁধে ২৩ লাখ ২১ হাজার ১৬৬ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এই দুটি প্রকল্পের সঙ্গে হাওরের কৃষক ও ফসলের কোনো সম্পর্ক নেই। এই দুটি প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে পৌর শহরের নবীনগর হতে হালুয়ারঘাটমুখী সড়ক পাহাড়ি ঢলের পানি থেকে রক্ষা পাবে বলে এলাকাবাসী জানিয়েছে। এটি ফসল রক্ষার কোনো কাজে লাগবে না।

স্থানীয়রা জানায়, এটি সরকারি কর্মকমিশনের (পিএসসি) বর্তমান চেয়ারম্যানের গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার একমাত্র সড়ক। নদীর তীরে হওয়ায় পাকা সড়ক বর্ষায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই সড়কটি সংস্কারের জন্য তিনি সরকারের বিভিন্ন মহলে লিখিত অলিখিতভাবে বলে আসছেন। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ এই কর্মকর্তার নেক নজরে আসতে ইউএনও ইসরাত জাহান ও স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আবুল বরকত উদ্যোগ নেন। তাঁরা উপজেলায় পরিকল্পনার সময় হাওরের বরাদ্দের টাকায় দুটি প্রকল্প তৈরি করে তড়িঘড়ি অনুমোদন দেন।

একই উপজেলায় ‘জোয়াভাঙ্গা হাওরের উপপ্রকল্পে ২ দশমিক ৯৫০ কিলোমিটার হতে ৪ দশমিক ২৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত ১ দশমিক ৩০০ কিলোমিটার ডুবন্ত বাঁধের সেতু বন্ধকরণ’ করা হচ্ছে। এই প্রকল্পে আরো ১৩ লাখ ৪৩ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এখানে এর আগে কখনো হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধের নামে প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়নি। এই প্রকল্পে কৃষক হিসেবে জাহানারা বেগম নামের যাঁকে সদস্য রাখা হয়েছে, তিনি গত বছর হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধের দুর্নীতি মামলার আসামি।

খবর পেয়ে ‘হাওর বাঁচাও, সুনামগঞ্জ বাঁচাও আন্দোলন’-এর নেতারা তিনটি প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করেছেন। তাঁরা অভিযোগ করেন, এখানে রাস্তা তৈরি হলে ফসল রক্ষার বদলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণ হবে।

হালুয়ারঘাট এলাকার কৃষক বলেন, ‘দুই-তিন দিন আগে কাজ শুরু হয়েছে। আমরা জিজ্ঞেস করে জানতে পারি, দেখার হাওর রক্ষার জন্য এই বাঁধ দেওয়া হচ্ছে। এটা শুনেই মানুষ হাসাহাসি শুরু করেছে।’ তিনি জানান, এখানে কোনো হাওর নেই। তা ছাড়া কোনো দিন এই দিকে পানি ঢুকে হাওরের ফসল তলিয়েছে, এমন খবর জানা যায়নি। তবে বর্ষায় কয়েকটি গ্রাম ও শহরের একটি পাড়ার মানুষের চলাচল করতে সমস্যা হয়।

হাওর বাঁচাও সুনামগঞ্জ বাঁচাও আন্দোলন-এর জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ান বলেন, ‘এই তিন প্রকল্পের কোনো প্রয়োজন নেই। এখানে বাঁধ না হওয়ার কারণে হাওরের ফসল গেছে, এই রেকর্ড পাউবো, এমনকি স্থানীয়দের কাছেও নেই। কৃষকের ফসল রক্ষার টাকা দিয়ে অন্য কাজ করার নৈতিক অধিকার কারো নেই।

সদর ইউএনও ইসরাত জাহান বলেন, ‘হাওরের ফসল রক্ষা টাকায় অন্য কাজ করা যাবে না, এমন কোনো কথা নেই। তা ছাড়া এই প্রকল্প দুটি উপজেলা কমিটি সভা করে চাহিদার ভিত্তিতে গ্রহণ করেছে। এই প্রকল্প গ্রহণ করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড, আমি সভাপতি হিসেবে শুধু অনুমোদন দিয়েছি।

সুনামগঞ্জ পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী আবু বকর সিদ্দিক ভূইয়া বলেন, ‘আমার অধীন কর্মকর্তাকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারি, উপজেলা কমিটির সভাপতি সভায় সিদ্ধান্ত নিয়ে জরুরি হিসেবে এই দুটি প্রকল্প গ্রহণ ও অনুমোদন করিয়েছেন। তবে কাজ শুরুর পর নিম্নমানের হওয়ায় গত ১২ জানুয়ারি আমরা কাজ বন্ধ করে দিয়েছি।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর