সালমা ঘর ভেঙ্গে বের হয়ে এসেছে, যে ঘর ওর ছিল না

সাদিয়া নাসরীন ॥

সালমা ঘর ভেঙ্গে বের হয়ে এসেছে, যে ঘর কখনো ওর ছিলো না। মাটির মেয়ে সালমা, গানের মেয়ে সালমা পেরেছে সম্মানহীন জীবনে আপসের দাহ থেকে মুক্ত হতে। সালমা পেরেছে সুখী মেয়ের ঐতিহ্য রক্ষার দায় থেকে মুক্ত হয়ে জীবনের পথে আসতে। শেষ পর্যন্ত সে পেরেছে কলঙ্কের ভয়, ভালো-মন্দ, সতীত্ব, নারীত্ব, মাতৃত্বের মহিমা, নিরাপদ জীবনের হাতছানিকে উপেক্ষা করতে। সালমা, তুমি পেরেছো শেকল ভাঙ্গার গান গাইতে। তোমার ওই শেকল ভাঙ্গার ছন্দের চেয়ে সুন্দর কোন কবিতা লেখেনি কোন কবি। ওই শৃঙ্খল ভাঙ্গার শব্দের চেয়ে সমধুর কোন গান গায়নি কোন শিল্পী।
সাদিয়া নাসরীন

লেখক: সাদিয়া নাসরীন

তুমি এতোদিন মুখ খোলনি। কিন্তু তারপর ও আমি বুঝি তোমাকে প্রতিমূহুর্তে পেরুতে হয়েছে নিষেধেরর কাঁটাতার তোমার ওই সুরটুকু বাঁচিয়ে রাখার জন্য। পথের কাঁটায় রক্ত না ঝরিয়ে কোন মেয়ে জীবনের কাছে আসতে পেরেছে বলো এই পুরুষের পৃথিবীতে? তুমি আপোস ও করতে চেয়েছিলে। তুমি সুর থেকে দূরে ছিলে অনেক বছর। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তুমি পারলে। তুমি উচ্চারণ করতে পারলে সেই অমোঘ বাণী, “আমি প্রয়োজনে মরবো, কিন্তু লড়াই চালিয়ে যাবো”। লড়াই তো করে যেতেই হবে মেয়ে, তোমাকে লড়াই করতে হবে নিজের জীবন, নিজের ঘর আর নিজের পৃথীবির জন্য। মনে রেখো, কখনোই যুদ্ধ বন্ধ করা যাবে না। লড়াই ছাডা মুক্তি মেলেনা। মুক্তি নিরাপদ আরামে স্নান করার চৌবাচ্চা নয়, মুক্তি মানে অপার সমুদ্র। আছে হাঙ্গর, কুমির আর উত্তাল ঢেউ। তবুও জীবন চাইলে এই মুক্তির লড়াই করে যেতেই হবে তোমাকে সারাজীবন। তবেই না তুমি বাঁচবে, তুমুল বাঁচবে, খলখলিয়ে বাঁচবে। এই জীবন তোমার, এর চালক তুমি।

সালমার মহান স্বামী (?) শিবলী আজ একটা অনলাইন পত্রিকায় বিয়ে বিচ্ছেদ নিয়ে কথা বলেছে। এবং ঠিক তাই তাই বলেছে যা শোনার জন্য এই সমাজ কান পেতে ছিলো। এবং যা পড়ার জন্য আমি পপকর্ণ নিয়ে, এক কাপ চা নিয়ে আয়েস করে বসেছিলাম।

শিবলী বলেছে, “সালমা উশৃঙ্খল, সালমার চরিত্র ভালো নয়, সালমা রাত বিরেতে বিভিন্ন জায়গায় গান গায়, সালমা তার অতি উচ্চ বংশের মান মর্যাদা রাখতে পারেনি”। সে আরো বলেছে, “আমরা চাচ্ছিলাম সে একটা লিমিটেশনের মধ্যে থাকুক। ঢাকায় গ্রোগ্রাম করুক, বড় বড় প্রোগ্রামে অংশ নিক। কিন্তু ওর কথা এটা নয়। ওর কথা হলো সে আমেরিকা বা দেশের বাইরে যাবে, নাটক ও অভিনয় করবে। রাত-বিরাত স্টুডিওতে গিয়ে কাজ করবে। এসব করতে পারিবারিকভাবে আমরা নিষেধ করেছি”। কী নির্মল বিনোদন (হা হা হা হা হা)!

শিবলী ভাইয়া, আপনার মতো পুরুষদের জন্য আমার গভীর সমবেদনা ও দুই মিনিট নিরবতা। আপনি গাছেরটা ও খাবেন আবার তলারটা ও কুড়োবেন তা কি করে হয়? আপনি একজন সেলিব্রেটি শিল্পীকে বিয়ে করে নিজেকে লাইমলাইটে আনবেন, আবার তাকে লিমিটেশন দিবেন, কেমনে ভাই? আপনি কেন রাজনীতি করবেন, কখন করবেন, কীভাবে করবেন, কতটুকু করবেন, এমপি হবেন না মন্ত্রী হবেন সেই লিমিট কী সালমা করেছিলো ? সালমা বাচ্চা টেক কেয়ার করতোনা, আপনি করতেন কী ? ও, আপনি তো আবার পুরুষ মানুষ!! মাতৃত্ব আবার নারীরই স্বার্থকতা!! সত্যি ভাত দেয়ার মুরোদ না থাকলে ও কিল দেয়ার গোঁসাই আপনারা !! তো ভাইয়া, এই দেশে তো ‘স্বামী’র দেওয়া লিমিটে চলার মতো মেয়ে কম ছিলোনা। তাদের ফেলে আপনি একটা গানের মেয়েকে, যে রাত বিরাতে সে গান গেয়ে বেড়ায় (যাদের আপনারা উশৃঙ্খল বলেন, চরিত্রহীন বলেন আর কি) বিয়ে করতে গেলেন কেন? সে গান গেয়ে আপনাকে ঘুম পাড়াবে বলে? নাকি ‘মিস্টার সালমা’ হওয়ার লোভ জয় করতে পারেননি বলে?

আপনার হিসেবে একটু ভুল ছিলো শিবলী ভাইয়া। এদেশে টাকা থাকলে রাজনীতির মাঠে ফাঁকা গোল দেওয়া যায় সহজেই। কিন্তু সালমারা যুগে যুগে নিজেকে প্রমাণ করেই সালমা হয়। সালমাদের স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা এই পৃথিবীতে পাঠান। সেদিনের সেই বাচ্চা মেয়েটি যখন মাটি গন্ধ নিয়ে উঠে এসে এই ইট-পাথরের হিসেবের নিক্তি পাল্লায় মাপা আলো ঝলমল রিয়েলিটি শো জয় করেছিল, সেদিন কিন্তু এক ইঞ্চি যায়গা কেউ ছেড়ে দেয়নি ওকে। তাই সালমা ও আপনাকে কোন ছাড় দেয়নি। আপনার ওই ‘লিমিটেশনের’ দেয়াল গুড়িয়ে দিয়ে বের হয়ে এসেছে।

তোমাকে অভিনন্দন, সালমা। ‘মিসেস’ এমপি বা মন্ত্রী হওয়ার লোভ তুমি জয় করতে পেরেছো। তুমি বুঝতে পেরেছো স্বাধীনতা একজন মানুষের প্রথম অধিকার। কোন মুল্যেই, কোন লোভেই, কোন শেকলেই সে স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া যায় না। মনে রেখো জীবনে দুঃখ জরা আসবে, তুমি হোঁচট খাবে বারবার। কিন্তু সকল দুঃখ-ধুলো বালি ঝেড়ে উঠে দাঁড়াবে তুমি। তুমি পারবে, কারন সালমারা সব পারে। তুমি সাহসী, তুমি শক্তিশালী। এই শক্তি কেউ ছিনিয়ে নিতে পারবে না। জীবন জয় করার ক্ষমতা হোক তোমার। আলো আসুক।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর