সরিষা থেকে মৌমাছির সাহায্যে বাংলাদেশের বিখ্যাত মধু চাষ

হাওর বার্তা ডেস্কঃ হলুদে সৌন্দর্যের সমারোহ মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর। শ্রীনগর উপজেলার কয়েকটি গ্রামে বিস্তৃত দিগন্ত মাঠজুড়ে আবাদ হয়েছে সরিষা চাষ। আর এ সরিষা ক্ষেত থেকে মধু সংগ্রহে মধুচাষিরা আসতে শুরু করেছেন। ইতোমধ্যে সরিষা থেকে মৌমাছির সাহায্যে বাংলাদেশের বিখ্যাত মধু সংগ্রহকারী বিএসটিআইয়ের অনুমতিপ্রাপ্ত ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত মধুমতি মৌচাষ প্রকল্পের সদস্যরা এসেছেন।

তারা সারা বছরই দেশের বিভিন্ন জেলায় ঘুরে মধু সংগ্রহ করেন। মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সরিষার চাষ একটি লাভজনক পেশা। একদিকে যেমন সরিষার পরাগায়ন বাড়ায়, তেমনি সরিষার ১০ ভাগ ফলন বাড়ায়। এদিকে, খাটি মধু কেনার জন্য ঢাকাসহ বিভিন্ন অঞ্চল থেকেও মধু কিনতে লোকজন আসছে মধুমতি মৌচাষ প্রকল্পের জমিতে।

দেশের বিভিন্ন জেলায় মধু সংগ্রহের পর মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলা বীরতারা ইউনিয়নের সাতগাঁও গ্রামে মধু চাষিরা আসছেন। গত কয়েকদিন আগে সাতগাঁও গ্রামে মধু সংগ্রহে এসেছেন মধুমতি মৌচাষ প্রকল্পের সদস্যরা। তারা গত বছর শ্রীনগরের সাতগাঁওয়ের সরিষার জমি থেকে ২ টন মধু সংগ্রহ করেছেন।

তারা সরিষা ক্ষেতের পাশে মৌমাছির সাহায্যে মধু সংগ্রহের জন্য চাকের বাক্স ফেলে রাখেন। সেই বাক্সে ১০-১৫টি পর্যন্ত মোম দিয়ে চাকের ফ্রেম রাখা হয়। বাক্সে একটি রানি মৌমাছি রাখা হয়। রানি মৌমাছির কারণে সরিষা ক্ষেতের পাশে চাকের বাক্স যেখানেই রাখা হোক না কেন ওই বাক্সে মৌমাছিরা আসতে থাকে। চাকের বাক্সের মধ্যখানের নিচে ছিন্দ্র করে রাখা হয়।

সে পথ দিয়ে মৌমাছিরা আসা-যাওয়া করতে থাকে। জমি থেকে মধু সংগ্রহের পর মৌমাছিরা চাকের বাক্সে আসে। সরিষা ফুল থেকে মৌমাছিরা নেকটার (পাতলা আবরণ) চাকের বাক্সে নিয়ে আসে। মৌমাছির তাপ ও বাতাসের মাধ্যমে ৬-৭ দিন পর তা গাঢ় হয়ে মধুতে পরিণত হয়। এরপর মধুচাষিরা চাকের বাক্স খুলে চাকের ফ্রেম থেকে মেশিনের মাধ্যমে মধু উৎপাদন করেন।

এবার সরিষায় ফুল ভালো ধরেছে। ফুল বাড়ার কারণে মধুও বেশি পাওয়ার আশা করছেন তারা। যতদিন পর্যন্ত সরিষায় ফুল থাকবে ততদিন পর্যন্ত তারা সাতগাঁও থেকে মধু সংগ্রহ করবেন বলে মধুচাষিরা জানালেন। জমি থেকে মধু সংগ্রহ করায় সরিষা চাষিদের কোনো টাকা দিতে হয় না। মধুমতি মৌচাষ প্রকল্পের পরিচালক বেলায়েত হোসেন জানালেন, তারা বংশপরস্পরায় মধু উৎপাদন করে আসছেন।

তার বাবা মতি মিয়া ১৯৬২ সালে ভারতের হিমালয় উত্তর প্রদেশ থেকে বাংলাদেশে সর্বপ্রথম প্রশিক্ষণ নিয়ে মৌচাষ শুরু করেন। তার বাবার পর তিনি এই ব্যবসা শুরু করে বেশ ভালো আছেন। জাতীয় প্রেস ক্লাবে জাতীয় মৌচাষ কল্যাণ সমিতি আয়োজিত সম্মেলনে মতিমধু মৌচাষ প্রকল্প ওরফে বেলায়েত হোসেন শ্রেষ্ঠ পুরস্কার পায়।

মতিমধু মৌচাষ প্রকল্পের আরেক পরিচালক মো. পাবেল হোসেন জানান, তারা সারা বছরই মধু সংগ্রহ করে থাকেন বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায়। তার বাবা বেলায়েত হোসেনের কাছ থেকে মধুচাষ শিখেছেন। বিদেশি প্রজাতির মৌমাছি আসায় সরিষা ক্ষেতে ভালো মধু পাওয়া যাচ্ছে।

৭ দিন পর পর ১২-১৩ মণ মধু সংগ্রহ করছেন। তারা জমিতে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা কেজি দরে মধু বিক্রি করছেন। যতদিন মধু পাওয়া যাবে, তারা ততদিন সাতগাঁও থেকে মধু সংগ্রহ করবেন।

এরপর ধনিয়া ও কালোজিরার মধু সংগ্রহের জন্য পরিদপুর, শরীয়তপুর ও গোপালগঞ্জ থেকে লিচুর মধু সংগ্রহ করবেন লিচুর বাগানে গিয়ে। এরপর মৌমাছিরা সুন্দরবন চলে যাবে। সুন্দরবনের পানি লোনা হওয়ায় এবং মৌমাছির ক্ষতি হওয়ায় তারা সেখানে মধু উৎপাদনে যান না বলে জানালেন এই মধুচাষি।

মতি মধু মৌচাষ প্রকল্পের কর্মচারিরা জানালেন, তারা মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগরের সাতগাঁও গ্রামে গত ১৫-২০দিন ধরে মধু সংগ্রহ করছেন। সাতগাঁও গ্রাম থেকে তারা কয়েক মণ মধু সংগ্রহও করেছেন।

মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলা কৃষি অফিসার কল্যাণ কুমার সরকার জানালেন, মৌমাছি চাষ প্রকল্প দেখে যুবকরা এখানে আসতে শুরু করেছে এবং মৌমাছি চাষ প্রকল্প দেখে তারা উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন।

স্থানীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানিয়েছে, এ বছর মুন্সীগঞ্জ জেলায় ৩ হাজার ৫ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষ হয়েছে। এরমধ্যে শ্রীনগর উপজেলায় ৩০০ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষ হয়েছে। গত বছর জেলা থেকে ৫ টন অর্থাৎ ২০ লাখ টাকার মধু সংগ্রহ করা হয়েছিল। এই বছর আরও বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর