হাওর বার্তা ডেস্কঃ হজরত আবু সুফিয়ান ইবনে হারব (রা.) ছিলেন প্রখ্যাত সাহাবি উমাইয়া খিলাফতের প্রতিষ্ঠাতা হজরত মুয়াবিয়া (রা.) এবং উম্মুল মুমিনিন হজরত উম্মে হাবিবা (রা.) এর সম্মানিত পিতা। ইসলামের প্রাথমিক যুগে তিনি মক্কার কাফের মুশরিকদের একজন গণমান্য নেতা ছিলেন। তখন তিনি ছিলেন ইসলামের একজন ঘোরতর শত্রু। বদর, ওহুদ ও খন্দক যুদ্ধে তিনি মুসলমানদের বিপক্ষে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। মক্কা বিজয়ের পর রাসুলুল্লাহ (সা.) কাবাঘরে বা আবু সুফিয়ানের ঘরে অথবা নিজ নিজ ঘরে আশ্রয়গ্রহণকারী সবার নিরাপত্তাদানের ঘোষণা করেন। মক্কার কাফের মুশরিকদের অবর্ণনীয় জুলুম-নির্যাতনের প্রতিশোধ গ্রহণ না করে সবাইকে ক্ষমা করে দেন। ইসলামের এ মহান আদর্শে মুগ্ধ হয়ে সবাই দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করেন। তখন হজরত আবু সুফিয়ান (রা.)ও তার স্ত্রী-পুত্র সবাইকে নিয়ে সপরিবারে ইসলাম গ্রহণ করেন। অবশ্য তার কন্যা উম্মে হাবিবা (রা.) ইসলামের প্রাথমিক যুগে স্বামীসহ ইসলাম গ্রহণ করেন এবং কাফেরদের অত্যাচার থেকে বাঁচতে হাবশায় হিজরত করেন। হাবশায় গিয়ে তার স্বামী ইসলাম ত্যাগ করে খ্রিস্টান হলেও তিনি ইসলামের ওপর অটল থাকেন। পরে শত্রুর হাতে তার স্বামী নিহত হন। এরপর হাবশার বাদশা নাজ্জাশির উদ্যোগে রাসুলুল্লাহ (সা.) এর সঙ্গে তার বিবাহ হলে তিনি মদিনায় আগমন করেন। হজরত আবু সুফিয়ান (রা.) ঈমান গ্রহণের পর থেকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ইসলামের একনিষ্ঠ অনুসারী ছিলেন।
ইসলাম গ্রহণের আগে রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াস একদিন তার কাছে লোক প্রেরণ করেছিলেন। তিনি তখন ব্যবসা উপলক্ষে কোরাইশদের কাফেলায় সিরিয়ায় ছিলেন। আল্লাহর রাসুল (সা.) সে সময় আবু সুফিয়ান ও কোরাইশদের সঙ্গে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য হুদাইবিয়ার সন্ধিতে আবদ্ধ ছিলেন। আবু সুফিয়ান (রা.) তার সাথীদের সঙ্গে নিয়ে রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াসের কাছে এলেন এবং দোভাষীকে ডাকলেন। অতঃপর জিজ্ঞেস করলেন, এই যে ব্যক্তি নিজেকে নবী বলে দাবি করেÑ তোমাদের মাঝে বংশের দিক থেকে তাঁর সবচেয়ে নিকটাত্মীয় কে? আবু সুফিয়ান (রা.) বলেন, বংশের দিক দিয়ে আমিই তাঁর নিকটাত্মীয়। তিনি বললেন, তাঁকে আমার অতি নিকটে আন এবং তাঁর সাথীদেরও তার পেছনে বসিয়ে দাও।
অতঃপর তার দোভাষীকে বললেন, তাদের বলে দাও, আমি তার কাছে সে ব্যক্তি সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞেস করব। যদি সে আমার কাছে মিথ্যা বলে, তখন সঙ্গে সঙ্গে তোমরা তাকে মিথ্যুক বলবে। আবু সুফিয়ান (রা.) বলেন, ‘আল্লাহর কসম! আমার যদি এ লজ্জা না থাকত যে, তারা আমাকে মিথ্যাবাদী বলে প্রচার করবে, তবে আমি অবশ্যই তার সম্পর্কে মিথ্যা বলতাম।’
আবু সুফিয়ান (রা.) পরবর্তী ঘটনা বর্ণনা করে বলেন, তিনি রাসুলুল্লাহ (সা.) সম্পর্কে আমাকে সর্বপ্রথম যে প্রশ্ন করেন তা হলো, বংশমর্যাদার দিক দিয়ে তোমাদের মধ্যে সে কীরূপ? আমি বললাম, তিনি আমাদের মধ্যে খুব সম্ভ্রান্ত বংশের। তিনি বললেন, তোমাদের মধ্যে এর আগে আর কখনও কি কেউ এরূপ কথা বলেছে? আমি বললাম, না। তিনি বললেন, তাঁর পূর্বপুরুষের মধ্যে কেউ কি বাদশাহ ছিলেন? আমি বললাম, না।
তিনি বললেন, সম্ভ্রান্ত মর্যাদাবান শ্রেণীর লোকেরা তাঁর অনুসরণ করে, নাকি দুর্বল লোকেরা? আমি বললাম, দুর্বল লোকেরা। তিনি বললেন, তাদের সংখ্যা কি বাড়ছে, না কমছে? আমি বললাম, তারা বেড়েই চলেছে। তিনি বললেন, তাঁর ধর্মে ঢুকে কেউ কি অসন্তুষ্ট হয়ে তা ত্যাগ করে? আমি বললাম, না। তিনি বললেন, তাঁর দাবির আগে তোমরা কি কখনও তাঁকে মিথ্যার অভিযোগে অভিযুক্ত করেছ? আমি বললাম, না। তিনি বললেন, তিনি কি সন্ধি ভঙ্গ করেন? আমি বললাম, না। তবে আমরা তাঁর সঙ্গে একটি নির্দিষ্ট সময়ের সন্ধিতে আবদ্ধ আছি। জানি না এর মধ্যে তিনি কী করবেন। আবু সুফিয়ান (রা.) বলেন, এ কথাটি ব্যতীত নিজের পক্ষ থেকে আর কোনো কথা যোগ করার সুযোগই আমি পাইনি। তিনি বললেন, তোমরা তাঁর সঙ্গে কখনও যুদ্ধ করেছ কি? আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি বললেন, তাঁর সঙ্গে তোমাদের যুদ্ধের পরিণাম কী হয়েছে? আমি বললাম, তাঁর ও আমাদের মধ্যে যুদ্ধের ফলাফল কূপের বালতির মতো। কখনও তাঁর পক্ষে যায়, আবার কখনও আমাদের পক্ষে আসে। তিনি বললেন, তিনি তোমাদের কীসের নির্দেশ দেন? আমি বললাম, তিনি বলেন, তোমরা এক আল্লাহর ইবাদত করো এবং তাঁর সঙ্গে কোনো কিছুর অংশীদার সাব্যস্ত করো না এবং তোমাদের পূর্বপুরুষরা যা বলে তা ত্যাগ করো। আর তিনি আমাদের সালাত আদায়ের, সত্য বলার, চারিত্রিক নিষ্কলুষতার এবং আত্মীয়দের সঙ্গে সদাচরণ করার নির্দেশ দেন।
অতঃপর তিনি দোভাষীকে বললেন, তুমি তাকে বল, আমি তোমার কাছে তাঁর বংশ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছি।
তুমি তার জবাবে উল্লেখ করেছ যে, তিনি তোমাদের মধ্যে সম্ভ্রান্ত বংশের। প্রকৃতপক্ষে রাসুলদের তাদের কওমের উচ্চ বংশেই পাঠানো হয়ে থাকে। তোমাকে জিজ্ঞেস করেছি, এ কথা তোমাদের মধ্যে এর আগে আর কেউ বলেছে কিনা? তুমি বলেছ, ‘না’। তাই আমি বলছি, আগে যদি কেউ এরূপ বলত, তবে আমি অবশ্যই বলতাম, ইনি এমন এক ব্যক্তি, যিনি তাঁর পুর্বসূরির কথারই অনুসরণ করছেন। আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করেছি, তাঁর পূর্বপুরুষদের মধ্যে কোনো বাদশাহ ছিলেন কিনা? তুমি তার জবাবে বলেছ, ‘না’। তাই আমি বলছি যে, তাঁর পূর্বপুরুষের মধ্যে যদি কোনো বাদশাহ থাকতেন, তবে আমি বলতাম, ইনি এমন এক ব্যক্তি যিনি তাঁর বাপ-দাদার বাদশাহি ফিরে পেতে চান। আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করেছিÑ এর আগে কখনও তোমরা তাঁকে মিথ্যার অভিযোগে অভিযুক্ত করেছ কিনা? তুমি বলেছ, ‘না’। এতে আমি বুঝলাম, এমনটি হতে পারে না যে, কেউ মানুষের ব্যাপারে মিথ্যা পরিত্যাগ করবে আর আল্লাহর ব্যাপারে মিথ্যা বলবে। আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করেছি, সম্ভ্রান্ত লোক তাঁর অনুসরণ করে, না সাধারণ লোক? তুমি বলেছ, সাধারণ লোকই তাঁর অনুসরণ করে। আর বাস্তবেও এই শ্রেণীর লোকেরাই হন রাসুলদের অনুসারী। আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করেছি, তারা সংখ্যায় বাড়ছে না কমছে? তুমি বলেছ, বাড়ছে। প্রকৃতপক্ষে ঈমানে পূর্ণতা লাভ করা পর্যন্ত এরকমই হয়ে থাকে।
আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করেছি, তাঁর দ্বীনে প্রবেশ করে কেউ কি অসন্তুষ্ট হয়ে তা ত্যাগ করে? তুমি বলেছ, ‘না’। ঈমানের স্নিগ্ধতা অন্তরের সঙ্গে মিশে গেলে ঈমান এরূপই হয়। আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করেছি, তিনি সন্ধি ভঙ্গ করেন কিনা? তুমি বলেছ, ‘না’। প্রকৃতপক্ষে রাসুলরা এরূপই, সন্ধি ভঙ্গ করেন না। আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করেছি, তিনি তোমাদের কীসের আদেশ দেন? তুমি বলেছ, তিনি তোমাদের এক আল্লাহর ইবাদত করা ও তাঁর সঙ্গে অন্য কিছুর অংশীদার স্থাপন না করার নির্দেশ দেন। তিনি তোমাদের নিষেধ করেন মূর্তিপূজা করতে আর তোমাদের আদেশ করেন সালাত আদায় করতে, সত্য বলতে ও সচ্চরিত্র থাকতে। তুমি যা বলেছ তা যদি সত্যি হয়, তবে শিগগিরই তিনি আমার পায়ের নিচের জায়গার অধিকারী হবেন।
(তথ্য সূত্র : বোখারি : ০৭)।