রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি: বিচারের প্রতিক্ষায় ক্ষতিগ্রস্তরা

স্মরণকালের ভয়াবহ রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির ৪ বছর আজ। ২০১৩ সালের এই দিনে সাভারে যেন নেমে এসেছিল ‘রোজ কেয়ামত’৷

রানা প্লাজা ধসে নিহত হয়েছিলেন ১ হাজার ১৩৫ জন পোশাক শ্রমিক৷ গুরুতর আহত এক হাজারেরও বেশি৷ আহতদের অনেকে আজও আতঙ্কগ্রস্ত৷ পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ পাননি ক্ষতিগ্রস্তরাও৷ দীর্ঘ ৪ বছর পরও হারিয়ে যাওয়া স্বজনকে পেতে অপেক্ষায় কারও মা, কারও স্ত্রী ও পরিবার।

রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি বিচারের প্রতিক্ষায় ক্ষতিগ্রস্তরাজানা গেছে, এ ঘটনায় দায়ের করা মামলায় পলাতক আসামিদের গ্রেফতারে কেটে গেছে প্রায় ১ বছর। এ কারণে ভবনের মালিকসহ ৪৮ আসামির কারোরই সাজা হয়নি। এখন প্রশ্ন সবার যে, রানা প্লাজা মামলার বিচার কবে শেষ হবে?

রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় হত্যা মামলাসহ মোট ৩টি মামলা দায়ের হয়। হত্যা মামলায় সাক্ষী করা হয় ৫৯৪ জনকে। ইমারত নির্মাণ আইনের মামলায় ১৩০ জনকে আর দুদকের মামলায় সোহেল রানার বাবা-মাসহ ১৭ জনকে আসামি করা হয়। হত্যা ও ইমারত নির্মাণ আইনে পৃথক দু’টি অভিযোগপত্র দাখিল করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সিনিয়র এএসপি বিজয় কৃষ্ণ কর।

বিগত চার বছরের সময়ের মধ্যে ইমারত নির্মাণ আইনের মামলায় গত বছরের ১৪ জুন আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আদালত। ঢাকার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোস্তাফিজুর রহমানের আদালতে মামলাটির সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে।

অন্যদিকে হত্যা মামলায় একই বছরের ১৮ জুলাই রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানাসহ ৪১ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে মামলার বিচার কাজ শুরু করেন আদালত। ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ এস এম কুদ্দুস জামানের আদালতে মামলাটির বিচার চলছে।

এদিকে অবৈধ, নকশাবহির্ভূত ও ছয় তলার অনুমোদিত ভবন দশ তলায় উন্নীত করায় দুদকের (দুর্নীতি দমন কমিশন) উপ-সহকারী পরিচালক এস এম মফিদুল ইসলাম বাদি হয়ে সাভার মডেল থানায় সোহেল রানার বাবা-মাসহ ১৭ জনকে আসামি করে অপর একটি মামলা করেন।

এ মামলায় ২০১৪ সালের ১৬ জুলাই মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে দুদকের উপ-পরিচালক এস এম মফিদুল ইসলাম ভবন মালিক সোহেল রানাসহ ১৮ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন।

ইমারত নির্মাণের মামলায় সাক্ষ্য হয়নি:

রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় করা ইমারত নির্মাণ আইনের মামলায় ভবন মালিক সোহেল রানাসহ ১৮ জনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য গ্রহণ হয়নি।

গত ১২ এপ্রিল বুধবার মামলাটির সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য দিন ধার্য ছিল। কিন্তু এদিন মামলার মূল নথি জেলা জজ আদালতে থাকায় রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষ্য গ্রহণ পেছানোর জন্য সময়ের আবেদন করেন।

ঢাকার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোস্তাফিজুর রহমান শুনানি শেষে সময়ের আবেদন মঞ্জুর করে সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য আগামী ১৭ মে দিন ঠিক করেন।

এ মামলার আসামিরা হলেন- ভবন মালিক সোহেল রানা, তার বাবা আব্দুল খালেক ওরফে কুলু খালেক, মা মর্জিনা বেগম, সাভার পৌরসভার মেয়র আলহাজ রেফাত উল্লাহ, কাউন্সিলর মোহাম্মাদ আলী খান, উপসহকারী প্রকৌশলী রাকিবুল হাসান রাসেল, নিউওয়েব বাটন লিমিটেডের চেয়ারম্যান বজলুস সামাদ আদনান, সাইট ইঞ্জিনিয়ার মো. সারোয়ার কামাল, আমিনুল ইসলাম, নিউওয়েব স্টাইলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহমুদুর রহমান তাপস, ইথার টেক্সটাইলের চেয়ারম্যান আনিসুর রহমান ওরফে আনিসুজ্জামান, সাভার পৌরসভার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা উত্তম কুমার রায়, প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম, গার্মেন্টস ব্যবসায়ী মাহবুবুল আলম, প্রাক্তন সহকারী প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান, নগর পরিকল্পনাবিদ ফারজানা ইসলাম, নান্টু কন্ট্রাকটার এবং রেজাউল ইসলাম।

মামলার নথিপত্র সূত্রে জানা যায়, সোহেল রানাসহ ৭ আসামি বর্তমানে কারাগারে আছেন। ৭ জন পলাতক আছেন। আর সোহেল রানার বাবা আবদুল খালেক ও মা মর্জিনা বেগমসহ ২৭ জন জামিনে মুক্ত রয়েছেন।

প্রসঙ্গত, ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা নামক ভবন ধসে ১ হাজার ১১৭ জনকে মৃত উদ্ধার করা হয়। পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরো ১৯ জন মারা যায়। ধ্বংসস্তুপ থেকে ২ হাজার ৪৩৮ জনকে জীবিত হয়। মৃত উদ্ধারকৃতদের মধ্যে ৮৪৪ জনের লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ডিএনএ পরীক্ষার নমুনা রেখে ২৯১ জনের অসনাক্তকৃত লাশ জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয়। জীবিত উদ্ধারকৃতদের মধ্যে ১ হাজার ৫২৪ জন আহত হন। তদের মধ্যে গুরুতর আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেন ৭৮ জন।

শনাক্ত হয়নি ১০৩ পোশাক শ্রমিকের পরিচয়:

স্বজনদের সন্ধান পেতে ডিএনএর নমুনা সিস্নপ নিয়ে কখনো কবরস্থানে, কখনো হাসপাতালে যোগাযোগ করেছেন অনেকে। এখনও শনাক্ত হয়নি ১০৩ পোশাক শ্রমিকের পরিচয়। কিন্তু বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা এ ১০৩ কবরের ডিএনএ নমুনার কোড খুঁজে পাচ্ছে না নিহতের পরিবার। জুরাইন কবরস্থানে কবরগুলোতে নেই কোনো শনাক্তকরণ নম্বর।

গোলাপী বেগম (৩০) কাজ করতেন আটতলা রানা প্লাজার চারতলার একটি গার্মেন্টস কারখানায়৷ ভবন ধসের তিনদিন পর তাকে উদ্ধার করা হয়৷ তার ডান হাত, ডান পা-সহ শরীরের একাংশ অবশ হয়ে গেছে৷

গোলাপী বেগম জানান, এখন আর তার কোনো চিকিৎসা হচ্ছে না৷ চিকিৎসা খরচ আর ক্ষতিপূরণ বাবদ তিনি মোট দেড় লাখ টাকা পেয়েছেন৷

মোহাম্মদ আমিনুল এবং রাজ্জাকেরও একই অবস্থা৷ তারা এখন আর কাজ করতে পারেন না৷ ঐ ঘটনার পর তিন-তিনটি পোশাক কারখানায় কাজ নিয়েছিলেন৷ কিন্তু কোনোটাতেই তিনদিনের বেশি কাজ করতে পারেননি৷ ভয়ে হাত-পা কাঁপছিল৷ তারাও সব মিলিয়ে দেড় লাখ টাকার বেশি সহায়তা পাননি৷

মামলার সরকারি কৌঁসুলি আনোয়ারুল কবির জানিয়েছেন, মামলার বিচারকার্য শুরু হয়েছে। দ্রুত বিচার নিষ্পত্তিও হবে বলে আশা করা যায়। হত্যা ও ইমারত নির্মাণ আইনের মামলা দু’টির বিচার কার্যক্রম এ বছরে শেষ হবে বলে আশা করা যায়।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর