যাদের দিয়ে লাশ আনিয়েছিল তাদেরও গুলি করে

২৫ মার্চ ১৯৭১ সাল। সে রাতে ঢাকায় বর্বরোচিত গণহত্যা চালায় পাকিস্তানি সেনারা। নিরস্ত্র নারী-পুরুষ-শিশুও রেহাই পায়নি। অপারেশন সার্চলাইট নামের পাকিস্তানি সেনাদের সে অপারেশনের অন্যতম টার্গেট হয়েছিল ঢাবির জগন্নাথ হল। শত শত বাঙালির রক্তে রঞ্জিত হয় জগন্নাথ হলের মাটি। সে রাতে কী ঘটেছিল, কীভাবে হত্যা করা হয়েছিল শিক্ষক-ছাত্র-কর্মচারীদের? সেই ভয়াবহ রাতের কথা বললেন রাজকুমারী দাস। তার সঙ্গে কথা বলেছেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক লায়েকুজ্জামান। একাশি বছরের বৃদ্ধা রাজকুমারী বেঁচে আছেন ২৫ মার্চ রাতের ভয়াল সেই গণহত্যার স্মৃতি নিয়ে। সে রাতের কথা মনে পড়লে এখনও অঝোরে কাঁদেন তিনি। তিনি হারিয়েছেন তার প্রিয়তম স্বামীকে। পাকিস্তানি সেনারা বাসা থেকে ধরে নিয়ে সামান্য দূরে জগন্নাথ হলের মাঠে গুলি করে হত্যা করে তার স্বামী মনভরণ দাসকে। তিনি চাকরি করতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের নিপা ভবনে। পরিবার নিয়ে বসবাস করতেন জগন্নাথ হলের মাঠের পাশে কর্মচারীদের জন্য নির্মিত টিনশেড ঘরে। সে রাতের বর্ণনা দিতে গিয়ে রাজকুমারী বলেন, ‘২৫ মার্চের রাত শেষ, ২৬ মার্চের সকাল প্রায়, চারদিক ফর্সা হয়ে এসেছে। পাকিস্তানি সেনারা এসে আমার স্বামীকে ধরে নিয়ে গেল। হলের মাঠের মধ্যে নিয়ে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করল। সেখানে লাশের স্তূপ, একটার পর একটা আহত-নিহত মানুষের দেহ। ‘বাঁচাও… বাঁচাও…’ আর ‘জল… জল’ আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। সেনারা গাড়ির দিকে চলে যাচ্ছে। এ সময়ে ‘দেখে আসি আমার ছেলেটা জল চায় কি না’ বলে মাঠের দিকে ছুটে গেলেন আমার শাশুড়ি। শিশু ছেলে-মেয়েদের নিয়ে আমি দাঁড়িয়ে রইলাম ঘরের সামনে। বড় ছেলেটার বয়স তখন এগারো হবে। মেয়ে ও আরেক ছেলে আরও ছোট। শাশুড়িসহ আমরা সবাই গুলির আওয়াজ শুরুর সঙ্গে সঙ্গে খাটের নিচে শুয়ে পড়ি। মাঝে-মধ্যে বড় বড় আলো জ্বলে উঠলে ঘরের ভেতরও আলোকিত হয়। চারদিকে গুলি আর বোমার শব্দ। ‘বাঁচাও… বাঁচাও…’ চিত্কার। বুটের আওয়াজ। আগুনের তাপ। সে এক নারকীয় তাণ্ডব। মনে হচ্ছিল কোনো এক মহাপ্রলয় চলছে। আমার স্বামী লুকিয়েছিলেন বাসার আলমারির পেছনে। শেষ রাতের দিকে আমাদের বাসার সামনে বুটের আওয়াজ পেলাম। টিনের চালে একটানা গুলির শব্দ। হঠাত্ করে দরজায় লাথি। উর্দুতে দরজা খুলতে বলা হল। আমার শাশুড়ি দরজা খোলামাত্র দশ-এগারো জন পাকিস্তানি সেনা ঢুকে পড়ল ঘরের ভেতরে। আমার স্বামীকে খুঁজে পায়নি। আমাদের বের করে বারান্দায় এনে দাঁড় করাল। ছেলে-মেয়ে ও শাশুড়িকে নিয়ে বারান্দায় দাঁড়ালাম। আমাদের সামনে দাঁড়ানো সেনারা। সেখানে দাঁড়িয়ে দেখছি লোকজন ধরাধরি করে জগন্নাথ হলের মাঠের উত্তরদিকের খালি জায়গায় লাশ এনে জড়ো করছে। পাকিস্তানি সেনারা আমাদের কাছে নানা প্রশ্ন করে, তাদের কোনো ভাষা বুঝতে পারি না। এর মধ্যে আমাদের পাশের টিনশেড ঘরগুলোতে আগুন দেওয়া শুরু করল খান সেনারা। আগুন দেওয়ার আগে কী যেন একটা পাউডার ঘরের চালে ছিটিয়ে দেয়, তারপর গুলি করলেই আগুন ধরে যায়। আমাদের ঘরেও আগুন দেওয়ার কথা বলল খান সেনারা, আগুনের কথা শুনে আমার স্বামী ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। তিনি বেরিয়ে আসা মাত্র একজন খান সেনা হাতের রাইফেল দিয়ে তার ঘাড়ে একটা আঘাত করে। আঘাতে তিনি মাটিতে পড়ে গেলেন। আবার মাটি থেকে তুলে পেছনে অস্ত্র ঠেকিয়ে জগন্নাথ হলের সুধীর বাবুর ক্যান্টিনের দিকে নিয়ে গেল। আমরা সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকলাম। আমাদের কিছু বলল না। ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আমরা পাকিস্তানি সেনাদের তাণ্ডব দেখছি। ছেলে-মেয়েগুলো আমার আঁচল ধরে ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে গায়ের সঙ্গে মিশে আছে। চোখের সামনে বহুদিনের সাজানো সংসার ঘরে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে, পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। সেনারা দিগ্বিদিক গুলি ছুড়ছে। আগুন দিচ্ছে। যাকে সামনে পাচ্ছে তাদের কাউকে গুলি করছে, কাউকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। যাদের ধরে নিচ্ছে তাদের দিয়ে লাশ বহন করিয়ে হলের মাঠে এনে জড়ো করছে। এভাবেই ভোর হয়ে গেল। ধীরে ধীরে চারদিক ফর্সা হতে শুরু করেছে। এর মধ্যে দেখলাম, যে লোকগুলোকে দিয়ে লাশ আনিয়েছিল, তাদেরকেও লাশের স্তূপের পাশে লাইন ধরিয়ে দাঁড় করিয়ে গুলি করল। লোকগুলো পড়ে গেল। পড়ে যাওয়ার পরও তাদের ওপর গুলি চালাতে থাকে সেনারা। সূর্য ওঠার পরপরই পাকিস্তানি সেনারা এলাকা ছাড়তে শুরু করে। তখনও জগন্নাথ হলের মাঠ থেকে ‘জল… জল’ বলে আওয়াজ আসছিল। ঠিক এমন সময়ে আমার শাশুড়ি ছেলের খোঁজে লাশের স্তূপের দিকে ছুটে গেলেন। ছেলে-মেয়েদের পোড়া ঘরের সামনে দাঁড় করিয়ে শাশুড়ির পেছনে পেছনে আমিও গেলাম। স্বামীকে খুঁজে পেলাম। তখনও জীবিত ছিলেন তিনি। আহত লোকটাকে আমরা দুজন ধরে নিয়ে এলাম। তিনি ‘জল… জল’ বলে চিত্কার করছেন। বাসার পাশের কল থেকে একটু জল এনে মুখে দিলাম। তার কিছু সময় পরই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তিনি। তখন কী করব ভাবতে পারছিলাম না। পরে লোকজনের কথায় আবার দুজনে মিলে লাশটা সেই স্তূপের কাছে রেখে এলাম।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর