মানিকগঞ্জে তিনটি আসনেই হারতে পারে আওয়ামী লীগ

জেলার তিনটি আসনই ধরে রাখতে চাচ্ছে আওয়ামী লীগ। কিন্তু হাজার কোটি টাকার উন্নয়নমূলক কাজ করলেও নানা বির্তক, দলীয় কোন্দল তিন সংসদ সদস্যদের নিকট আত্মীয় স্বজনদের দুর্নীতি সর্বোপরি তৃণমূল আওয়ামী লীগ নেতা কর্মীদের এলাকায় প্রভাব বিস্তারকে লাগাম টেনে না ধরতে পারলে তিনটি আসনই হাতছাড়া হয়ে যাবার আশঙ্কা রয়েছে ক্ষমতাসীন দলের।

জেলার ৭ টি উপজেলা নিয়ে জাতীয় সংসদের তিনটি আসন রয়েছে। যদিও আগে চারটি আসন ছিল। জেলার শিবালয়, ঘিওর ও দৌলতপুর উপজেলাকে নিয়ে মানিকগঞ্জ- ১ আসন, সিংগাইর, হরিরামপুর এবং সদর উপজেলার ১টি ইউনিয়নকে নিয়ে মানিকগঞ্জ- ২ আসন। মানিকগঞ্জ সদর উপজেলা এবং সাটুরিয়া উপজেলাকে নিয়ে মানিকগঞ্জ- ৩ নং আসন গঠিত।

মানিকগঞ্জ জেলা ছিলো বিএনপি অধ্যুষিত এলাকা। ১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের ১ম জাতীয় নির্বাচনে মানিকগঞ্জের ৪ টি আসনেই আওয়ামী লীগ দখলে নেয়। এরপর জিয়াউর রহমান, এরশাদের আমল, এমনকি ৯১ ও ৯৬ এর নির্বাচনেও ৪ টি আসনই দখল ছাড়া ছিলো আওয়ামী লীগের। দীর্ঘ ৩৩ বছর পর ফখরুদ্দিন সরকারের অধীনে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জোট সরকার জেলার তিনটি আসনই ফিরে পায়।

২০০৮ এর নির্বাচনে মানিকগঞ্জ-১ আসন থেকে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী আনুয়ারুল হক, মানিকগঞ্জ ২ আসন থেকে আওয়ামী জোট ও জাতীয় পার্টি মনোনীত প্রার্থী এস, এম আব্দুল মান্নান এবং মানিকগঞ্জ ৩ আসন থেকে আওয়ামী লীগ প্রার্থী জাহিদ মালেক স্বপন নির্বাচিত হয়ে ৩৩ বছরের দীর্ঘ খরা ঘোচান।

গেল নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নেওয়ায় তিনটি আসনের মধ্যে দুটি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতাসহ আওয়ামী লীগের দখলে আসে। তার মধ্যে মানিকগঞ্জ ১ আসনে ফোক সম্রাজ্ঞী মমতাজ বেগম ও মানিকগঞ্জ ৩ আসনে জাহিদ মালেক স্বপন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। শুধু মাত্র মানিকগগঞ্জ -২ আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী ও বাংলাদেশ টেস্ট ক্রিকেট দলের ১ম অধিনায়ক নাইমুর রহমান দুর্জয় নির্বাচন করে জয়ী হন।

জাতীয় নির্বাচনের আরও লম্বা সময় থাকলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি দলীয় সংসদদেরকে হুঁসিয়ারী করে দেন আগামী নির্বাচনের মত এবার নির্বাচন হবে না।এবার প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন হবে তাই কারও দায়িত্ব তিনি নিবেন না। এতে করে মানিকগঞ্জের আওয়ামী লীগের চিত্র পাল্টে যেতে শুরু করে। আবার গত ২০ মে গণভবনেও তলব করে সংসদ সদস্যদের আগামী নির্বাচনকেন্দ্রীক বিভিন্ন পরামর্শ দিয়েছেন নেত্রী।

মানিকগঞ্জ -১ আসন: ঘিওর, দৌলতপুর ও শিবালয়কে নিয়ে গঠিত এ আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য নাঈমুর রহমান দুর্জয় বিভিন্ন বিতর্কে জড়িয়ে পড়ছেন। তার নির্বাচনী এলাকায় জমি দখল, চাকরি বাণিজ্য, বালু মহল দখলের সরাসরি অভিযোগ উঠেছে।এছাড়া তার আত্মীয় স্বজনের বিরুদ্ধে রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। ফলে কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন এ জনপ্রিয় ক্রিকেট তারকা।

এ আসনেই এবার মনোনয়ন চাইবেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আব্দুস সালাম, যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক এস, এম জাহিদ এবং বর্তমান সংসদ সদস্য। নির্বাচনের আরও সময় থাকলেও আপাতত এই তিন প্রার্থীই মাঠে রয়েছেন।

এ ব্যাপারে বতর্মান জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আব্দুস সালাম জানান, বতর্মান সংসদ সদস্য নাঈমুর রহমান দুর্জয় শুধু দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি নয় দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগও তার বিরুদ্ধে। তিনি মানিকগঞ্জ পৌর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী রমজান আলীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে অন্য প্রার্থীর পক্ষে সরাসরি কাজ করেন। তার ও পরিবারের বির্তক কর্মকাণ্ডের দায়ভার আওয়ামী লীগ নেবে না।

এ নেতা আরও জানান, আমি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা ছিলাম হুট করে রাজনীতিতে আসিনি, তাই নেত্রী আমাকেই মনোনয়ন দিবে আর সেইভাবে সর্বসাধারণের সঙ্গে আমি আছি থাকব।

মানিকগঞ্জ ২ আসন: এ আসনের সংসদ সদস্য হচ্ছেন ফোক সম্রাজ্ঞী ও বিশিষ্ট কণ্ঠশিল্পী মমতাজ বেগম। তাকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী করার আগে বিএনপির মঞ্চে গান পরিবেশন করার অভিযোগে মানিকগঞ্জ আওয়ামী লীগ অবাঞ্চিত ঘোষণা করে। কিন্ত ২ আসন থেকে দলীয় টিকেট পেয়ে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। কিন্তু ২ বছর পার হলেও তিনি তার নির্বাচনী আসনের দলীয় কোন্দল মিটাতে পারেননি। বরং গেল পৌর নির্বাচনে নিজ প্রভাব খাটিয়ে তার ছেলেকে মনোনয়ন দিয়ে সমালোচনায় আসেন এ সংসদ সদস্য। তাছাড়া সেতু মন্ত্রী তার এলাকায় সেতু উদ্ধোধন করতে গিয়ে তাকে না পেয়ে মোবাইলে বলেন, তুমিত টাকা নিয়ে গান গাও তাই তোমার সময় হয় না উন্নয়নমূলক কাজ উদ্ধোধনের।

এ আসনের সংসদ সদস্য মমতাজ বেগম আরও বিতর্ক জরিয়ে পড়েন ২০১৭ সালে দুটি বিদ্যালয়ে বার্ষিক ক্রিয়া প্রতিযোগিতায় তাকে প্রধান অতিথি না করায় অনুষ্ঠান মঞ্চ ভাঙচুরের অভিযোগ থাকায়। তাছাড়া তার অনুসারী ছাত্রলীগ বিশেষ করে যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক রাজার বিরুদ্ধে অন্যের দোকান ঘর দখলের অভিযোগ রয়েছে।

মমতাজের সঙ্গে শক্ত প্রার্থী হচ্ছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক যুব ও ক্রীয়া বিষয়ক সম্পাদক আরিফিন আলম টুটুল। কেন্দ্রীয় পদ হারিয়ে তিনি শেষ চেষ্টা করছেন এ আসনের সংসদ প্রার্থী হবার জন্য। কিন্তু আওয়ামী লীগের টিকেট প্রত্যাশী দুই প্রার্থীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ থাকাতে এ আসন হারার সম্ভবনা রয়েছে।

মানিকগঞ্জ- ৩: এ আসনের সংসদ সদস্য হচ্ছেন ঢাকার সাবেক মেয়র কর্নেল আব্দুল মালেক এর ছেলে জাহিদ মালেক স্বপন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে ভোটে নির্বাচিত হলেও গেল নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বচিত হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর গুড লিস্টে নাম থাকায় হয়ে যান স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী।

তার বিরুদ্ধে কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ না থাকলেও তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। মানিকগঞ্জ পরিবহন সেক্টর, এ আসনের সীমানা এলাকায় বালু মহলও তাদের দখলে। এছাড়া শেয়ার বাজার কেলেংকারিতে তার ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠান সানলাইফ জড়ীত ছিল। তাছাড়া সম্প্রতি জেলা আওয়ামী লীগের কমিটিতে অনেক ত্যাগী নেতা কর্মীদের স্থান হয়নি এ সংসদের ইশারায়।

অপরদিকে সম্প্রতি গণমাধ্যমে ৭৯ জন সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয় পাচ্ছেন যে তালিকা প্রকাশিত হয়েছে। তার মধ্যে নাম রয়েছে এ আসনের সংসদ সদস্যের। তার সমর্থকরা দাবি করছেন শুধুমাত্র এই আসনেই দৃশ্যমান যে উন্নয়ন হয়েছে স্বাধীনাতার পর কোনো সরকারের সংসদ সদস্যই তা করতে পারেনি।

এ ব্যাপারে বালিয়াটী ইউনিয়ন চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. রুহল আমিন জানান, জাহিদ মালেক স্বপন ১০০% নিশ্চিত তিনিই মনোনয়ন পাবেন। তিনি যে এবার প্রতিমন্ত্রী হলেন তা তিনি মিডিয়ার মাধ্যমেই জানতে পারেন। তিনি ক্ষমতালোভী নন তাই এবারও তিনি মনোনয়ন পাবেন।

তবে এ আসনে এখনও প্রকাশ্যে কোনো প্রার্থী না থাকলেও গোপনে দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করছেন বলে গুঞ্জন উঠেছে।

আওয়ামী লীগের মাঠের নেতারা মনে করছেন মানিকগঞ্জের তিনিটি আসনের সংসদই তৃণমূল থেকে উঠে আসেননি। তাই তারা বিভিন্ন কোন্দল বিতর্কে জড়িয়ে পড়ছেন। এ ব্যাপারে তারা বলছেন মানিকগঞ্জ -১ আসনের সংসদ সদস্য নাঈমুর রহমান দুর্জয় জাতীয় ক্রিকেট দলের তারকা ক্রিকেটার, ২ আসনের ফোক সম্রাজ্ঞী খ্যাত মমতাজ বেগম, ৩ আসনের সংসদ সদস্য হচ্ছেন একজন ব্যবসায়ী। এরা কেউ ছাত্র রাজনীতি কিংবা তৃণমূল রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না। তাই তাদের গুটি কয়েকজন নেতা ছাড়া ভোটারদের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগ নেতারা বলেন ২০০৮ পর এ সরকার অনেক উন্নয়নমূলক কাজ করলেও ব্যক্তি জনপ্রিয়তা নেই তাদের। দল মনোনয়ন ও সরকারে ক্ষমতায় থাকলেও কাওয়াদের অভাব হয় না। এসব কারণে সংসদদের নিকট তৃণমূল নেতাকর্মীদের চেয়ে কাওয়াদের কদর সবার আগে।

তবে দল করেন না এমন সুশীল সমাজ ও তরুণরা দাবি করেন আমরা অনেকেই জীবনের প্রথম ভোট নৌকায় দিয়েছি, কিন্তু স্থানীয় নির্বাচনে ঐসব ক্ষমতাসীন দলের সদস্যরা সাধারণ মানুষের উপর যে মানসিক অত্যাচার করেছেন এর প্রভাব থাকবে আগামী জাতীয় নির্বাচনে। তাছাড়া স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা সাধারণ মানুষের উপর দলীয় প্রভাব বিস্তার লাগাম টেনে না ধরতে পারলে ব্যাপক উন্নয়নমূলক কাজ হলেও আবার তিনটি আসনই হাত ছাড়া হতে পারে সরকার দলের। এমনই আশঙ্কা স্থানীয়দের।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর