ভোটযুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি

সংগঠন আর আগামী জাতীয় নির্বাচনকে টার্গেট করে মাঠ পর্যায়ের কাজ শুরু করেছে বিএনপি। এর মধ্যে দলের সিনিয়র নেতাদের সমন্বয়ে ৫১টি টিম করে দেশের ৭৭টি সাংগঠনিক ইউনিট পর্যবেক্ষনের মাধ্যমে তৃণমূলের সাংগঠনিক অবস্থাসহ আগামী নির্বাচনের সার্বিক বিষয়ে তুলে ধরার জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। অপরদিকে চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নিজস্ব উইং থেকে গোপনে মাঠের নেতাদের বিষয়ে খোঁজখবরও নেওয়া হচ্ছে বলে নিশ্চিত করেছে দলীয় সূত্র।

বিএনপি সূত্র জানায়, আগামী নির্বাচনকে টার্গেট করে দলকে শক্তিশালী করার সকল উদ্যোগ মুখ থুবড়ে পড়ার পর এবার কেন্দ্রীয় নেতাদের দিয়ে বিভিন্ন এলাকা সফরের মধ্য দিয়ে দলের প্রকৃত অবস্থান জানতে চায় হাইকমান্ড। এর পাশাপাশি বিএনপি ঘরানার ২টি এনজিও দিয়েও অত্যন্ত গোপনে সারাদেশে দলের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের অবস্থান সম্পর্কে একটি ধারনা পেতে কাজ শুরু করা হয়েছে।

অন্যদিকে লন্ডনে চিকিৎসাধীন তারেক রহমানও নিজস্ব ও বিশ্বস্ত লোক দিয়ে সারাদেশে একটি জরিপ পরিচালনা করছেন। এসকল প্রতিবেদন সমন্বয় করে আগামী জাতীয় নির্বাচনের জন্য প্রার্থীদের একটি খসড়া তালিকা তৈরী করে পরবর্তী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার দিকে এগোচ্ছে দলটি। তবে সবকিছুর উর্ধ্বে সংগঠনকে শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেওয়া হবে। যে সকল এলাকায় কোন্দল রয়েছে তা নিরসনে জিরো টলারেন্স নেয়ারও নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি।

সূত্র জানায়, সম্প্রতি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দলের স্থায়ী কমিটি ও ২০ দলীয় জোটের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এসব বৈঠকে অংশ নেওয়া নেতারা একমত হয়েছেন যে, চলমান পরিস্থিতিতে আর ঘরে বসে থাকা যাবে না। এখনই নেতাকর্মীদের সক্রিয় করে আন্দোলনের জন্য প্রস্ততি নিতে হবে। একই সঙ্গে নির্বাচনের প্রস্ততিও রাখতে হবে। দলের কোনো কোনো নেতা খালেদা জিয়াকে সভা-সমাবেশের মাধ্যমে নেতাকর্মীদের চাঙ্গা রাখার প্রস্তাবও দেন। সম্প্রতি খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে একই প্রস্তাব দেন বিএনপিপন্থী কয়েকজন বুদ্ধিজীবীও।

সূত্র জানায়, নির্বাচনী প্রস্ততির অংশ হিসেবে ইতিমধ্যে নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের রূপরেখা প্রস্তুত করা হয়েছে। এছাড়া নির্বাচনী ইশতেহার ভিশন-৩০ কেও চূড়ান্ত করা হয়েছে। এই বছরের শেষে অথবা আগামী বছরের শুরুতে এই দুটি বিষয়কে জনসম্মুখে নিয়ে আসা হবে বলে সূত্র নিশ্চিত করেছেন। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া সংবাদ সম্মেলন করে সহায়ক সরকারের প্রস্তাবনা দেওয়ার পরপরই মাঠ পর্যায়ে দাবি আদায়ের আন্দোলনে যাবে দলটি। দলের হাইকমান্ড মনে করছে- নির্বাচনকালীন সরকারের ওই দাবিতে দেশব্যাপী আন্দালনের মধ্য দিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহন করলে একদিকে জনমত গঠন করা সম্ভব হবে অন্যদিকে নেতাকর্মীরাও চাঙ্গা থাকবে।

ভিশন ৩০ বিষয়ে জানতে চাইলে সূত্র জানায়, আগামী দিনে অর্থনৈতিক ভিত্তি শক্তিশালী করার উপর গুরুত্ব দিয়ে এই ইশতেহারকে সাজানো হয়েছে। এছাড়া মানুষের সকল মৌলিক চাহিদার পাশাপাশি সমাজ পরিবর্তনের বিষয়গুলোও থাকছে।

বিএনপি সূত্র আরও জানায়, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে অনড় বিএনপি। তবে এ নিয়ে চূড়ান্ত আন্দোলনে যাওয়ার আগে নেতাকর্মীদের চাঙ্গা করতে চাইছেন দলটির হাইকমান্ড। একই সঙ্গে তৃণমূলকে সক্রিয় করার মধ্য দিয়ে ছোটখাটো দ্বন্দ্বও মিটিয়ে নিতে চায় বিএনপি। এর জন্য একটি প্রতিবেদন তৈরি করে তা কেন্দ্রে জমা দিতে বলা হয়েছে সারাদেশের জন্য গঠিত টিম প্রধানদের। টিম গঠনের জন্য দেয়া চিঠিতে দলের চেয়ারপারসনের বরাত দিয়ে টিম প্রধানদের বেশ কিছু নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। এতে দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট জেলার নেতাদের নিয়ে কর্মীসভা করার কথা বলা হয়েছে।

পাশাপাশি জেলার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে কর্মীসভার দিনক্ষণ চূড়ান্ত করা এবং বিভাগীয় সাংগঠনিক ও সহ-সাংগঠনিক সম্পাদকদের তা অবহিত করতে বলা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট জেলার সব কেন্দ্রীয় নেতাকে টিমে অন্তর্ভুক্ত করার আহ্বান জানানো হয়েছে চিঠিতে। জেলার উদ্যোগে এসব কর্মিসভায় দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দলের অবস্থান ও দলের ঐক্য সম্পর্কে বক্তব্য রাখার অনুরোধ জানানো হয়েছে টিম প্রধানদের।

জানা গেছে, জেলা সফরকালে প্রতিটি টিম তৃণমূলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে সংশ্লিষ্ট জেলার একটি সাংগঠনিক প্রতিবেদন তৈরি করবেন। বিশেষ করে আন্দোলন করার মতো সাংগঠনিক সক্ষমতা রয়েছে কিনা, সে সম্পর্কে বিস্তারিত থাকবে এ প্রতিবেদনে। যারা আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে চান, নিজ নিজ এলাকায় তাদের গ্রহণযোগ্যতার বিষয়টিও স্থান পাবে তাতে।

জেলায় কোনো বিরোধ থাকলে তা মেটানোর চেষ্টার তাগিদ দিয়ে নির্দেশনায় বলা হয়েছে, সম্ভব না হলে তার কারণ উল্লেখ থাকবে প্রতিবেদনে। গত ২২ এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া এই জেলা সফর চলবে আগামী ৭ মে পর্যন্ত। এর পরে প্রত্যেক টিম লিডারকে তার এলাকা নিয়ে প্রতিবেদন তৈরী করে দলের কেন্দ্রীয় দফতর শাখায় জমা দিতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে ওই চিঠিতে। এদিকে ৫১টি টিম লিডারদের আগামীকাল মঙ্গলবার দলেল কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ডাকা হয়েছে। সকাল ১০টায় নয়াপল্টন কার্যালয়ে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম তাদেরকে জেলা সফর নিয়ে ব্রিফ করবেন বলে সূত্র জানিয়েছে।

টিমে যাদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তাদের মধ্যে রয়েছেন স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ড, আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, ভাইস চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) আলতাফ হোসেন চৌধুরী, মোহাম্মদ শাহজাহান, শামসুজ্জামান দুদু, ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন, আবদুল আউয়াল মিন্টু, মীর মোহাম্মদ নাছির, শওকত মাহমুদ, চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা মিজানুর রহমান মিনু, আতাউর রহমান ঢালি, যুগ্ম মহাসচিব মজিবর রহমান সারোয়ার, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, খায়রুল কবির খোকন, হাবিব উন নবী খান সোহেল, বিশেষ সম্পাদক ড. আসাদুজ্জামান রিপন প্রমুখ।

এদিকে লন্ডনের একটি সূত্র জানিয়েছে- আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে ইতিমধ্যে কাজ শুরু করা হয়েছে। খোঁজ খবর নেয়া হচ্ছে। নবম জাতীয় নির্বাচনের অনেক প্রার্থীকেই এবার পরিবর্তনের তালিকায় দেখা যাবে। এর মধ্যে সাবেক ছাত্রদল নেতা, দির্ঘদিন দলের বাইরে থাকা সংস্কারপন্থি হিসেবে পরিচিত অনেক নেতাকেও আগামী জাতীয় নির্বাচনে দেখা যাবে। আর এর অংশ হিসেবে তাদেরকে দলে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে। এর আগে নির্বাচনে অংশগ্রহনের পরিবেশ ফিরিয়ে আনার দাবি করে বিএনপির পক্ষ থেকে নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের রূপরেখা প্রনয়ন করবেন চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। এর পাশাপাশি দলকে নির্বাচনে অংশ নেয়ার প্রস্ততিও নেয়া হবে।
দলের সাংগঠনিক দূর্বলতা আর কোন কোন ক্ষেত্রে ভঙ্গুর অবস্থায় বিএনপির নির্বাচনী অংশগ্রহন কতটুকু সফলতা আসবে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ নিয়ে আমরা একটা টিম ওয়ার্ক করছি। নির্বাচনের আগে সবকিছুই ঠিক হয়ে যাবে বলে তিনি প্রত্যাশা করেন।

বিএনপির অপর একটি সূত্র জানিয়েছে, নির্বাচন নিয়ে ২০ দলীয় জোটের মধ্যেও কয়েকদফা বেঠক করেছে বিএনপির হাইকমান্ড। তাদেরকেও বিভিন্ন নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির অংশ নেওয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে দলটির অন্যতম উপদেষ্টা আতাউর রহমান ঢালি বলেন, বিএনপি নির্বাচনমুখী একটি রাজনৈতিক দল। আগামীকাল জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও, সেই নির্বাচনে অংশ নিতে আপত্তি নেই বিএনপির। তবে সেটি নির্বাচন হতে হবে, নির্বাচনের নামে তামাশা হলে চলবে না।

শান্তিপূর্ণ নির্বাচন ছাড়া দেশের বর্তমান সঙ্কট নিরসন সম্ভব নয় মন্তব্য করে তিনি বলেন, বিএনপি যেহেতু একটি গণতান্ত্রিক দল। এক্ষেত্রে আগামী জাতীয় নির্বাচন যখনই হোক না কেন, সেই নির্বাচনে অংশ নেয়ার প্রস্তুতি অবশ্যই বিএনপি নেবে। তবে সেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগে দেশে নির্বাচনী পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।

তিনি আরও বলেন, বিএনপি সংঘাত হানাহানি চায় না, শান্তিপূর্ণ জাতীয় সংসদ নির্বাচন চায়। যে নির্বাচনের মাধ্যমে দেশের চলমান গণতন্ত্রের সঙ্কট কেটে যাবে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর