ভালো নেই হাওরপাড়ের মৎস্যজীবীরা

হাওর বার্তাঃ   ঘরে চাল নেই। নেই তেল, নুন মরিচও। অর্ধহারে অনাহারে দিন কাটছে হাওর তীরের জেলে পরিবারের। এখন আয় রোজগার নেই, তাই অভাব অনটনেরও শেষ নেই। চলছে চরম দুর্দিন। এ বছর ধান নেই, মাছও কম। সব হারিয়ে নিঃস্ব হাওর তীরের কৃষি ও মৎস্যজীবী মানুষ। এখন মাছের ভরা মৌসুম। কিন্তু জেলেরা হাওরে জাল ফেলে হচ্ছেন হতাশ। মিলছে না আশানুরূপ মাছ। তাছাড়া ভাসমান পানিতে মাছ ধরা নিয়েও রয়েছে নানা বাধাবিপত্তি। যে এলাকায় জালে কম বেশি মাছ ধরা পড়ছে সেখানে মাছ ধরতে দিচ্ছেন না বিল ইজারাদার। বিলের আশপাশে ভিড়লেই নানা বিড়ম্বনা। দুর্ভোগগ্রস্তরা জানান, এ বছর হঠাৎ উত্তাল হাওর রাক্ষুসে হয়ে সবই গ্রাস করেছে। তাই বোরো চাষিদের মতো দুর্দিনে হাকালুকি হাওর তীরের মৎস্যজীবীরাও । এ সংকট কাটাতে নেই তাদের সহায় সম্বল। প্রতিদিনই নানাজনের আশার বাণী আর প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরিই তাদের সান্ত্বনা। দীর্ঘ প্রতীক্ষা। তারপরও মিলে না সে প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন। তাই তাদের এখনকার বাস্তব দৃশ্য বড়ই করুণ। আশানুরূপ কোনো সহায়তা এখনো জোটেনি তাদের। দু’বেলা দু’মুঠো ভাতের নিশ্চয়তা নেই। খেয়ে না খেয়ে দিন কাটে তাদের। বেঁচে থাকার সংগ্রামে প্রতিদিনই আগের মতো ছুটে চললেও তা হচ্ছে অসার। কারণ, এ বছর হাওর হারিয়েছে তার জৌলুস। আয় রোজগার নেই। তাই পরিবারের খাওয়া বাঁচা নিয়ে বাড়ছে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা। এমন দুশ্চিন্তায় এখন চোখে অন্ধকার দেখছেন। স্থানীয় মৎস্যজীবীরা জানালেন মড়কের পর জালে মাছ ধরা পড়ছে কম। অকাল বন্যা আর চলমান বর্ষণে এখন পানিতে টইটুম্বর হাওর হাকালুকি। অন্যান্য বছর এ সময় নানা জাতের দেশি প্রজাতির মাছ জালে ধরা পড়লেও এ বছর ভিন্ন চিত্র। সারা দিন জাল ফেলেও মিলছে না পর্যাপ্ত মাছ। তারপরও পরিবারের জীবিকার প্রয়োজন, অলস সময় আর নেশার টানে ভাসমান নতুন পানিতে জাল ফেলছেন মৎস্যজীবীরা। কিন্তু অনেকটা হতাশ হয়ে ফিরছেন বাড়িতে। যে হাওরকে উপলক্ষ করে চলে তাদের জীবন জীবিকা, সে হাওর এখন জীবিত থেকেও মৃত। তাই হাওর তীরের মানুষগুলো এখন চরম অসহায়। এ বছর চৈত্রের অকাল বন্যায় তাদের স্বপ্নের মৃত্যু ঘটেছে। টানা ভারিবর্ষণ আর উজানের পাহাড়ি ঢল কেড়ে নিয়েছে তাদের সোনালি ফসল। বোরো ধানের পর মরছে মাছ, গবাদিপশু আর জলজপ্রাণী ও উদ্ভিদ। উত্তাল হাওর একে একে গিলে খেয়েছে সব সম্পদ। বসতভিটা ছাড়া এখন হাতে আর অবশিষ্ট নেই বেঁচে থাকার অবলম্বনের মতো কোনো সম্পদ। এমন দুঃসময়ে বেকারত্ব ঘুচাতে মিলছে না অন্য পেশাও। তাই ঘুরেফিরে মাছ ধরা আর বিক্রি করাই তাদের একমাত্র নির্ভরযোগ্য পেশা। গতকাল সরজমিন হাকালুকি হাওর পাড়ের জেলেপল্লী হিসেবে পরিচিত কুলাউড়া উপজেলার ভূকশিমইল ইউনিয়নের তেঘরিঘাট, সাদিপুর, কুরবানপুর, মিরশংকর, বরমচাল ইউনিয়নের আলীনগর, জুড়ী উপজেলার জায়ফরনগর ইউনিয়নের শাহপুর, ফতুনগর ও বেলাগাঁও এলাকায় কথা হয় স্থানীয় মৎস্যজীবীদের সঙ্গে। তারা কান্নাজড়িত কণ্ঠে তুলে ধরেন তাদের অসহায়ত্বের কথা। তারা বলেন, জন্মের পর এত বড় দুর্যোগ আর দেখেননি তারা। অন্যান্য বছর বন্যা হলেও কিছু ধানও ঘরে তুলতে পেরেছেন। বানের পানিতে ধান গেলেও প্রচুর মাছ পেয়েছেন। কিন্তু এ বছর ভিন্ন। বোরো ধানের সঙ্গে মরেছে মাছও। জেলেপল্লীর বাসিন্দারা  ক্ষোভের সঙ্গে জানালেন, এখন পর্যন্ত তারা সরকারি তরফে কোনো সহায়তা পাননি। তারা বলেন, এমন চরম দুর্দিনে আশা ছিল সরকার আমাদের পাশে দাঁড়াবেন। সংকটময় এ দুর্যোগ কাটিয়ে উঠতে সহায়তা করবে। সরকারের তরফে এমন প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি শুনলেও এখন পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত মৎস্যজীবী হিসেবে আমরা কিছুই পাইনি। অকাল বন্যার পর হাওর পাড়ের মানুষের জন্য ওএমএস বা ভিজিএফের যে ত্রাণ সহায়তা এসেছিল তা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল থাকায় ওই সহায়তাও আমাদের কপালে জোটেনি। এখন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কাছে গেলে তারা বলেন মৎস্যজীবীদের জন্য এখনো বরাদ্দ আসেনি, এলে পাবেন। তারা ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, আমাদের এমন দুর্যোগ চলে গেলেও মনে হয় সরকারের ওই ত্রাণ সহায়তা আমাদের কাছে পৌঁছাবে না। গতকাল হাকালুকি হাওরের তেঘরিঘাট এলাকার সেতুর পাশেই জাল, ডরি ও ফড়িয়া (মাছ ধরার ফাঁদ) পেতে মাছ ধরছিলেন সলিম মিয়া, হরমুজ আলী, আছই মিয়া। কেমন মাছ ধরা পড়ছে জানতে চাইলে তারা বলেন, ‘ভাই আগের মাছ নাই। এ বছর মড়কের পর মাছ ধরা পড়ছে খুবই কম। সারা দিন ধরে ১০০ টাকারও মাছ পাই না। এ দিয়ে নিজে খাবো কী আর পরিবারের সদস্যরা খাবে কী।’ তারা জানান, মাছ যে একেবারেই নেই এমন নয়। সম্প্রতি ভারি বৃষ্টিতে নদী ভাঙনে সৃষ্ট বন্যায় হাওরের তীরবর্তী এলাকার বেশ কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হয়। এতে পুকুর ও মৎস্য খামারের মাছ ভেসে হাওরে আসে। এ বছর ধান পচে প্রচুর খাবার থাকায় ওই মাছগুলো হাওরের বিল এলাকায় চলে যাওয়ায় হাওর তীরবর্তী ভাসমান পানিতে জালে মাছ ধরা পড়ছে কম। আর বিল এলাকায় মাছ ধরা পড়লেও ইজারাদারদের কারণে মাছ ধরা তো দূরের কথা, নৌকা নিয়ে বিলের পাশে যাওয়াও কষ্টকর। হাওর পাড়ের ইসলামগঞ্জ বাজারের পশ্চিম পাশে মাছ ধরছিলেন কয়েকজন জেলে। তারা জানালেন, জমি বর্গা নিয়ে তারা চাষ করেছিলেন বোরো ধান। কিন্তু অকাল বন্যায় একটি ধানও ঘরে তুলতে পারেননি। এখন জালে মাছও ধরা পড়ছে কম। অন্যান্য বছর ধান না থাকলেও মাছ ছিল। কিন্তু এ বছর কিছুই নেই। তাই পরিবার পরিজন নিয়ে তারা দিশেহারা। হাওর পাড়ের স্থানীয় ইসলামগঞ্জ বাজার ঘাটে ও ঘাটের বাজারে প্রতিদিনই পর্যাপ্ত মাছ উঠলেও এ বছর উল্টো চিত্র। আগের মতো নেই পাইকারি কিংবা খুচরা মাছ ক্রেতা বিক্রেতার হাঁকডাক। মড়কের পর পুঁটি, ট্যাংরা, মলা, কাশখয়রা আর ছোট চাঁদা জাতীয় মাছ ছাড়া জেলেদের জালে ধরা পড়ছে না বড় মাছ। তাই স্থানীয় মাছের বাজারগুলোরও ক্রয় বিক্রয় কার্যক্রম ঝিমিয়ে পড়েছে। স্থানীয় মৎস্য বিভাগের তথ্যমতে, এ বছর হাকালুকি হাওরে মাছ মারা গেছে আনুমানিক ২৫ মেট্রিক টন। জেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয়ের তথ্যমতে, হাকালুকি হাওর তীরবর্তী এলাকায় নিবন্ধিত জেলে রয়েছেন ৪ হাজার। এ বছর দুর্যোগের পর হাওরে মাছের ঘাটতি পোষাতে বিল নার্সারির (হাওর এলাকার বিল বা পুকুরে পোনা উৎপাদন) জন্য ২৬ লাখ ৩০ হাজার টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে। অপরদিকে হাওরে রুই, কাতলা ও মৃগেল জাতীয় পোনা অবমুক্তের জন্য ২৮ লাখ টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে। চলতি মাসের মধ্যেই এসব পোনা হাওরে অবমুক্ত করা হবে। কুলাউড়া উপজেলা জ্যেষ্ঠ মৎস্য কর্মকর্তা মো. সুলতান মাহমুদ মানবজমিনকে বলেন, এটা সত্য হাওরের এ দুর্যোগের পর জেলেদের দুর্দিন যাচ্ছে। তিনি আশ্বস্ত করে বলেন, হাওরে পুঁটি, ট্যাংরা, মলাসহ ছোট মাছের পোনা দেখা যাচ্ছে। এ থেকে বোঝা যাচ্ছে হাওর থেকে মাছ বিলুপ্ত হয়নি। এ বছর যে পরিমাণ খাদ্য সৃষ্টি হয়েছে তাতে দ্রুত মাছ বৃদ্ধি পাওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে। আশা করছি কিছু দিনের মধ্যে হাওরে জেলেদের জালে পর্যাপ্ত মাছ ধরা পড়বে। ভুকশিমইল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. আজিজুর রহমান মনির মানবজমিনকে বলেন, এখন পর্যন্ত মৎস্যজীবী হিসেবে আলাদা কোনো ত্রাণ দেয়া হয়নি। তবে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জেনেছি ত্রাণ আসবে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর