বিএনপিতে সবাই নেতা

বিএনপির ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলে গঠনতন্ত্র চূড়ান্ত হলেও নির্বাহী কমিটির সদস্যসংখ্যা কত, তা স্পষ্ট হয়নি। এরই মধ্যে ৫০২ সদস্যের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। এ ছাড়াও ১৯ সদস্যের স্থায়ী কমিটি ও ৭৩ সদস্যের উপদেষ্টা পরিষদের নাম প্রকাশিত হয়। বিষয়ভিত্তিক ২৬টি উপকমিটিও ঘোষণা করা হবে খুব শিগগিরই। এর সদস্যসংখ্যা কত, তা স্পষ্ট না হলেও নেতারা বলছেন, প্রতিটি মন্ত্রণালয়ভিত্তিক উপকমিটিতে ১০ থেকে ১২ জন নেতাকে সম্পৃক্ত করা হবে। সেখানেও প্রায় ৩০০ নেতার জায়গা হবে। এর পরও চেয়ারপারসন চাইলে আরও নেতাকে কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করতে পারবেন। গঠনতন্ত্র ছাপা না হওয়া পর্যন্ত কমিটিতে পরিবর্তন, পরিমার্জন করা সম্ভব। এ নিয়ে দলের সিনিয়র এক নেতা ঠাট্টাচ্ছলে বলেন, ‘বিএনপিতে সবাই নেতা। আগামীতে কর্মী খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর হয়ে পড়বে।’

জানা যায়, পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিলে বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্যসংখ্যা ছিল ৩৫১। বিএনপি চেয়ারপারসনের বিশেষ বিবেচনায় ১০ ভাগ সম্পৃক্ত করা হয়। তাতে নির্বাহী কমিটির সদস্যসংখ্যা দাঁড়ায় ৩৮৬-তে। ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলে গঠনতন্ত্র উপকমিটিতে প্রস্তাব আসে ৪০৫ সদস্যের নির্বাহী কমিটির। কিন্তু ওই কমিটির সদস্যরা ৩৫১ সদস্যের কমিটির পক্ষেই অবস্থান নেন। সব ছাপিয়ে এখন ৫০২ সদস্যের নির্বাহী কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলে খালেদা জিয়াকে একক ক্ষমতাও দেওয়া হয়। কমিটির সদস্যসংখ্যা কত হবে, তিনিই নির্ধারণ করবেন। গঠনতন্ত্র ছাপা হওয়ার পরও কমিটি পরিমার্জন করার এখতিয়ার বেগম জিয়াকে দেওয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

গঠনতন্ত্র উপকমিটির এক সদস্য জানান, গঠনতন্ত্র এখনো অপূর্ণাঙ্গ অবস্থায় আছে। ছাপা না হওয়া পর্যন্ত কোনো কিছুই চূড়ান্ত নয়। সর্বশেষ গঠনতন্ত্রে মানবাধিকারবিষয়ক সম্পাদকের পদ ছিল না। কিন্তু কমিটিতে পদ দেওয়া হয়েছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক দুবার উল্লেখ করা আছে। কমিটি চূড়ান্ত হওয়ার পর এগুলো এখন সংশোধন করতে হবে। এরপর গঠনতন্ত্র ছাপা হবে।

এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, কাউন্সিলররা নির্বাচিত চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে কমিটি গঠনের পূর্ণ দায়িত্ব দিয়েছেন। তিনি যা ঘোষণা করছেন, তাই কাউন্সিলরদেরই সিদ্ধান্ত। চেয়ারপারসন চাইলে নির্বাহী কমিটির সদস্যসংখ্যা বাড়াতে পারেন। এটা সম্পূর্ণ তার এখতিয়ার। কমিটিতে লোকবলের সংখ্যা বৃদ্ধি কোনো সমস্যা নয় দাবি করে তিনি বলেন, এখানে সংখ্যা গুরুত্বপূর্ণ নয়। দেখতে হবে যোগ্য লোকেরা কমিটিতে ঠাঁই পাচ্ছেন কিনা। সূত্র জানায়, বিএনপিতে সবাইকে খুশি করার নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু এতে দলের বড় অংশই অখুশি। কমিটিতে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘনের পাশাপাশি অবমূল্যায়ন করা হয়েছে অনেক নেতাকেই। লঘুদণ্ডে গুরুতর শাস্তিও দেওয়া হয়েছে বেশ কয়েকজনকে। আন্দোলন সংগ্রামে ভূমিকা পালন করা নেতাদের গুরুত্বপূর্ণ পদে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। নেতাদের অভিযোগ, মামলা-হামলা নেই, আন্দোলন সংগ্রামে কোনো ভূমিকা নেই— এমন নেতারাই গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন। আবার যোগ্য ও দক্ষদের অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের চেয়েও কমিটিতে গুটিকয় নেতা ও কর্মকর্তার পছন্দের নেতারা প্রাধান্য পেয়েছেন বলে তৃণমূল নেতা-কর্মীদের অভিযোগ। তবে বিএনপির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা জানান, পদবঞ্চিত ক্ষুব্ধ নেতাদের কেউই বাদ থাকছেন না। এর মধ্যে ২৬টি বিষয়ভিত্তিক উপকমিটিতেই জায়গা হচ্ছে প্রায় ৩০০ নেতার। ঘোষিত কমিটিতেই আটটি পদ এখনো শূন্য। এক নেতার এক পদের বিধান কার্যকর হলে নির্বাহী কমিটিতে সম্পাদক-সহসম্পাদক পদে আরও অন্তত ৪০ নেতা যুক্ত হবেন। সব মিলিয়ে বিএনপিতে আরও সাড়ে তিনশ নেতাকে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। একইভাবে কমিটিতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার কাজ শুরু হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান, ‘কমিটি নিয়ে অনেকের অসন্তুষ্টি থাকতেই পারে। বিএনপি একটি বিশাল রাজনৈতিক দল। ৫০২ জনের কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। এতে সব যোগ্য লোককে জায়গা দেওয়া সম্ভব হয়নি। স্বাভাবিকভাবে এ বিষয়ে কিছু ক্ষোভ-অসন্তুষ্টি থাকতেই পারে। কিন্তু এটি একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে হয়েছে। সামগ্রিকভাবে এটা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়েছে।’ কমিটিতে কোনো রদবদল হবে কিনা— এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এ ব্যাপারে এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না। এক ব্যক্তি দুই পদে থাকবেন না। সে ক্ষেত্রে যে পদগুলো খালি হবে, সেখানে হয়তো যারা যোগ্য, তারা স্থান পেতে পারেন।’ জানা যায়, কমিটিতে যাচাই-বাছাইসহ শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে দায়িত্ব দিয়েছেন চেয়ারপারসন। দুই সপ্তাহের মধ্যেই কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির অসম্পূর্ণ কাজ সম্পন্ন করা হবে। সেই সঙ্গে দ্রুত মন্ত্রণালয়ভিত্তিক উপকমিটি গঠনের নির্দেশও দেওয়া হয়েছে। কমিটিতে অসঙ্গতিগুলো চিহ্নিত করে দ্রুত প্রতিকার করতে বলা হয়েছে।

কমিটি নিয়ে জিয়ার মাজারে যাবেন খালেদা : সদ্যঘোষিত নির্বাহী কমিটি নিয়ে আগামী সোমবার দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের মাজারে যাবেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। বিকাল ৪টায় শেরেবাংলানগরে জিয়ার মাজারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করবেন তিনি। পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ অনুষ্ঠানে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য, ভাইস চেয়ারম্যান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা, যুগ্ম মহাসচিব, সম্পাদক ও সহসম্পাদকসহ জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্যদের যথাসময়ে উপস্থিত থাকতে অনুরোধ জানিয়েছেন মহাসচিব মির্জা আলমগীর। গতকাল গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে তিনি এ অনুরোধ জানান।

আসছে অঙ্গসংগঠনের কমিটিও : জানা যায়, চলতি মাসেই জাতীয়তাবাদী যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের কমিটি ঘোষণা হবে। এরপর ছাত্রদলের কমিটি দেওয়া হতে পারে। এ নিয়ে যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদলের বর্তমান-সাবেক নেতাদের তালিকা সংগ্রহ করা হচ্ছে। এ ছাড়া জেলা ও মহানগর পর্যায়ে বিএনপি ও অন্য অঙ্গসংগঠনের যোগ্য নেতাদেরও পৃথক তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। এসব নেতার থেকে যারা যেখানে যোগ্য তাদের সেখানেই নেওয়া হবে। এর মধ্যে কেউ কেউ শূন্যপদে নির্বাহী কমিটিতে যেতে পারেন। অনেকেই বিষয়ভিত্তিক কমিটিতেও অন্তর্ভুক্ত হবেন। আবার যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদলের কমিটিতেও থাকবেন অনেকেই। এসব নিয়ে কাজ করছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা।

বিএনপির সিনিয়র এক নেতা জানান, বেগম খালেদা জিয়া পবিত্র হজে যাওয়ার আগেই যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের কমিটি দিয়ে যেতে পারেন। সৌদি আরব থেকে ফিরেই ছাত্রদলের আংশিক কমিটি ঘোষণা করতে পারেন। সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে হজে যাবেন তিনি। ওই তিন কমিটিতেও জায়গা হবে তরুণ নেতাদের। আবার মহানগর বিএনপিতেও রাখা হবে বিএনপির বঞ্চিত নেতাদের একটি অংশকে। জেলার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পর্যায়ের নেতারা কেন্দ্রে থাকলে ওইসব শূন্যপদেও নতুন নেতৃত্ব আসবে।

এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বিএনপির বিভিন্ন পদে আরও নেতার অন্তর্ভুক্তি হওয়ার সুযোগ আছে। বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনেও ঠাঁই পাবেন অনেকেই। বিএনপির কমিটির বাইরে যারা রয়েছেন তাদের সংখ্যা খুব একটা বেশি না। হয়তো অনেকেই প্রত্যাশা অনুযায়ী পদ পাচ্ছেন না, কিন্তু বিএনপির কমিটিতে থাকতে পারছেন।’

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর