প্রধানমন্ত্রী তাকে ডুবন্ত নৌকা জাগিয়ে তুলতে দায়িত্ব দিয়েছেন : মোস্তাফা জব্বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ এক. বামপন্থি ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতি থেকে মোহাম্মদ ইউসুফ উঠে এসেছেন। সুমহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করা এই মানুষটি আজীবন সমাজ পরিবর্তনের লড়াইয়ে নিবেদিত ছিলেন। কমিউনিস্ট পার্টির রাজনীতি করতে গিয়ে অনেক কমরেড পথের সাথী পেয়েছিলেন।

১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন আটদলীয় জোটে যে কজন নৌকা প্রতীক নিয়ে কমিউনিস্ট পার্টি থেকে বিজয়ী হয়েছিলেন তিনি ছিলেন তাদের একজন। পঞ্চম সংসদ নির্বাচন কাভার করতে গিয়ে চুপচাপ-নিরিবিলি গুটিয়ে থাকা এই নিরাভরণ, সাদামাটা ও নির্লোভ মানুষটিকে অনেকবার দেখেছি। সে সময় ভাঙনকবলিত কমিউনিস্ট পার্টির এমপিদের কেউ কেউ বিএনপিতে চলে গেছেন। কেউ কেউ গিয়েছিলেন গণফোরামে। মোহাম্মদ ইউসুফ যোগ দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগে।

বাবার দ্বিতীয় পক্ষের সন্তান হিসেবে পরবর্তীতে ব্যক্তিজীবনে একা, নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের টিকিট তিনি পাননি। রাজনীতির গতিপ্রবাহ পরিবর্তিত হওয়ায় সেই জনমতও ধরে রাখতে পারেনি। প্রায় দেড় যুগ ধরে রোগ-শোকে বাঁধা পড়ে তার জীবন। সম্প্রতি মোহাম্মদ ইউসুফের জীবন করুণ পরিণতির দিকে যায়। একজন সৎ-আদর্শিক ও নির্লোভ সাবেক এমপির জীবনে এতটাই করুণ পরিণতি দেখা দেবে কেউ চিন্তাও করতে পারেন না। কিন্তু মোহাম্মদ ইউসুফ ব্যক্তিগত সহায়সম্পত্তি যেটুকু ছিল তাও দান করে দেওয়ায় অর্থকষ্ট আর অসুখ-বিসুখ মিলে এক অমানবিক জীবনের মুখোমুখি হন।

চট্টগ্রাম-৭ আসন থেকে নির্বাচিত এই সাবেক এমপিকে সম্প্রতি দেখা যায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। পায়ে দগদগে ক্ষত, পরনে ময়লা পুরনো শার্ট-লুঙ্গি, জীর্ণশীর্ণ কুটির। আমাদের প্রতিনিধি সেই হৃদয়স্পর্শী সংবাদ পাঠালে আমরা প্রচার করি। প্রধানমন্ত্রীর ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারি আশরাফুল আলম খোকন তা বঙ্গবন্ধুকন্যার সামনে তুলে ধরেন। প্রধানমন্ত্রী সঙ্গে সঙ্গে তার দায়িত্ব নিয়ে নেন। প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হয়। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের আইসিইউতে ভর্তি করে তার উন্নত চিকিৎসা চলছে। এখন সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন— কে কার আগে কত বেশি মোহাম্মদ ইউসুফের পাশে দাঁড়াতে পারবেন।

চট্টগ্রাম পাহাড় ও সাগরবেষ্টিত প্রকৃতির এক অপার বিস্ময়কর নৈসর্গিক দৃশ্যে মুগ্ধকর রূপ নিয়ে এ দেশের মানুষের গৌরবময় এলাকা হিসেবে বিবেচিত। প্রাচ্যের রানী খ্যাত বীর চট্টলা অসংখ্য ধনাঢ্য ব্যক্তি, বিত্তশালী, রাজনীতিবিদ, সমাজপতি ও প্রশাসনের কর্মকর্তার পদচারণে মুখরিত। একজন সাবেক এমপির অসুখে বাঁধা নিঃসঙ্গ কষ্টের জীবন। তবু তাদের কারও মানবিক দৃষ্টিতে পড়েননি। ভাবলে অবাক লাগে চট্টগ্রামে এত এত মন্ত্রী, এত এত নেতা, এত এমপি-জনপ্রতিনিধি, এত এত বিত্তশালী; তবু কারও মানবিক হৃদয় কেঁদে ওঠেনি! তবু কেউ পাশে দাঁড়াননি। সারা জীবন মেহনতি মানুষের রাজনীতি করতে গিয়ে এত এত কমরেড পথের সাথী কমিউনিস্ট পেলেন।

তবু তারা কেউ খোঁজও নেননি। এখানেই একজন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার যতই সমালোচনা করি না কেন বঙ্গবন্ধুর কন্যা হিসেবে তার মানবিক হৃদয়ের গভীরতায় যেমন আপ্লুত হতে হয়, মুগ্ধ হতে হয়, কৃতজ্ঞ হতে হয়, হৃদয় নিঃসৃত শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় অভিনন্দন জানাতে হয়। এটা যেন বঙ্গবন্ধুকন্যাকেই মানায়। প্রকৃতির রূপ দেখে তিনি যেমন মুগ্ধ হন, মানুষের বেদনায়, কর্মীদের কষ্টে উতলা হয়ে ওঠেন। তিনি খেলার মাঠে মাশরাফিরা যখন ছক্কা হাঁকান তখন লাফিয়ে উঠে হাততালি দেন। নিমতলীর ট্র্যাজেডি যখন কাউকে এতিম করে দেয় মুজিবকন্যা সেখানে তাদের জননী হয়ে ওঠেন। সেই মেয়েগুলোর রাজকীয় বিয়ের ব্যবস্থা করেন।

বঙ্গবন্ধুকন্যার একান্ত সচিব আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিম বলেছিলেন, বিএনপি-জামায়াত শাসনামলে সারা দেশের নেতা-কর্মীরা প্রতিপক্ষের হামলায় যখন ঘরবাড়িছাড়া হন, আহত পঙ্গু হয়ে আসেন তখন তাদের এলাকার বড় বড় নেতারা চিকিৎসার দায়িত্ব নেননি। বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেছিলেন, ওরা তো আওয়ামী লীগ করে, বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি করে। তাদের দায়িত্ব আমাকেই নিতে হবে। এক কঠিন পরিস্থিতির মুখে তিনি সবার চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছিলেন।

তাই নয়, সারা দেশের নেতা-কর্মী, শিল্পী-সাহিত্যিক, কবি-সাংবাদিক যখন যে বিপদে পড়ে তার কাছে গেছেন তিনি কাউকে খালি হাতে ফেরাননি। কবি নির্মলেন্দু গুণকে চিকিৎসার জন্য ২০ লাখ টাকা দিয়েছিলেন। হুমায়ূন আহমেদ যখন মৃত্যুশয্যায় তখনো তার পাশে আর্থিক সহায়তা নিয়ে ছুটে গেছেন। জনসাধারণের জন্য, দলের গরিব নেতা-কর্মীর জন্য তার মানবিক হৃদয়ের দরজা পিতার মতো খোলা রেখেছেন।

এখানেই তাকে অভিনন্দন জানাতে হয়ে। মোহাম্মদ ইউসুফের এই করুণ পরিণতিতে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকেই দায়িত্ব নিতে হয়েছে। যেন সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা তার একার! আমার দেখা সমাজে অনেক বিত্তশালী থেকে বিজ্ঞ মানুষেরা মানবিক হৃদয় নিয়ে মানবতার সেবায় নিজেদের নিয়োজিত রাখেন। আমাদের রাজনীতিবিদরা মোহাম্মদ ইউসুফদের নিজেরা সাহায্য করতে না পারলেও সেসব বিত্তবান বা সমাজপতিকে কাছে নিয়ে গেলেও পারতেন। খালি হাতে ফিরে আসতেন না।

বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহানকে দেখেছি অনেক নিঃস্ব গরিব মানুষের চিকিৎসাসেবাই দেন না; প্রতি বছর হজ করতেও পাঠান। শিকদার গ্রুপের চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা জয়নুল হক শিকদারও অনেক মানুষকে নীরবে-নিভৃতে চিকিৎসাসেবা দিয়ে থাকেন। গৃহহীন মানুষকে ঘর করে দেন। তার ব্যাংক থেকে বিনা সুদে গরিবদের ঋণ দেন। প্রখ্যাত আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিকুল হক দুই হাতে কামান। আবার দুই হাতে মানবতার সেবায় সব দানও করেন। আমরা একটা অস্থির-অশান্ত বোধহীন সমাজে নিজেকে নিয়ে এতটাই ব্যস্ত যে, সমাজে চারদিকে কেউ অগাধ ভোগ-বিলাসে মত্ত। আর অন্যদিকে কেউ কেউ দারিদ্র্যের কঠিন চাপেই নয়, বিনা চিকিৎসায় মরছে। তাদের দায়িত্বটুকু মানবিক মানুষদের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে কার্পণ্য করি।

বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার কাছে আমার দুটি পরিবারের অমানবিক জীবনের চিত্র তুলে ধরতে ইচ্ছা করে। কখনো দেখা হলে বলতাম, অনেকবার ভেবেছি সেই সুযোগ হয় না বলে আজ লিখতে যাচ্ছি। প্রধানমন্ত্রীর প্রেস উইংয়ের সবাই খোকনের মতো গণমাধ্যম থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চোখ দেন কিনা জানি না। প্রধানমন্ত্রীর কাছে সব খবর পৌঁছে দেন কিনা তাও বুঝি না। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খবরের কাগজ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়েন এটিই ভরসা।

সুনামগঞ্জ আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ছিলেন মরহুম আকমল আলী মুক্তার। বঙ্গবন্ধু ভীষণ স্নেহ করতেন। বঙ্গবন্ধুর প্রতিও তার আস্থা-বিশ্বাস জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত হারাননি। আকমল আলী মুক্তারের সন্তানরা ছাত্রলীগের দুর্দিনে ভূমিকা রেখেছেন। সাব্বির আহমদ প্রায় বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন। সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ফারুক আহমদ জীবনযুদ্ধে লড়ে যাচ্ছেন। আকমল আলীর পরিবারের লোকজন অর্থনৈতিকভাবে এক অমানবিক পরিস্থিতির মুখোমুখি।

মুক্তিযুদ্ধের আরেক সংগঠক বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির নিবেদিতপ্রাণ কর্মী মরহুম সৈয়দ দেলোয়ার হোসেন অর্থকষ্ট ও চিকিৎসার অভাব এবং ভাতের কষ্ট নিয়ে ইন্তেকাল করেছেন। তার সন্তানরা রীতিমতো রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছেন। সুনামগঞ্জের আওয়ামী লীগ রাজনীতির সুদিনে অনেকে রাতারাতি অগাধ অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন। কিন্তু দলের দুঃসময়ের পরীক্ষিত নেতাদের পরিবারের প্রতি কোনো দায়িত্ববোধ কেউ পালন করেননি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া কেউ তাদের খোঁজ নেবে, এমনটি আমরাও বিশ্বাস করি না।

দুই. বছরের শুরুতেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার মন্ত্রিসভায় কিছুটা রদবদল করেছেন। এই রদবদলে চমক নিয়ে পুরস্কৃত করার চিত্র আছে। যেভাবে তিনি আজীবন তৃণমূলে দলের রাজনীতিতে ভূমিকা রেখেছেন অতীতে তাদের মন্ত্রিসভায় ঠাঁই দিয়েছেন। এবারও তিনি লক্ষ্মীপুরের আওয়ামী লীগ নেতা এ কে এম শাহজাহান কামালকে পূর্ণমন্ত্রী করেছেন। রাজবাড়ীর আওয়ামী লীগ নেতা কেরামত আলীকে প্রতিমন্ত্রী করেছেন। এ ছাড়া পুরনোদের মন্ত্রণালয়ে রদবদল ছাড়া তেমন পরিবর্তন নেই।

নারায়ণ চন্দ্র চন্দকে প্রতিমন্ত্রী থেকে মৎস্য ও পশুসম্পদ মন্ত্রণালয়ের পূর্ণমন্ত্রী করেছেন। শাহজাহান কামালকে বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিয়ে প্রবীণ রাজনীতিবিদ রাশেদ খান মেননকে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দিয়েছেন। মেনন নিজেও বলেছেন, আকাশ থেকে মাটিতে নামলাম। আনোয়ার হোসেন মঞ্জুকে পানিতে ও আনিসুল ইসলাম মাহমুদকে বনে নিলেও তাদের কাছে প্রতিক্রিয়া অভিন্ন। দুজনই যারা ফুল নিয়ে গিয়েছিলেন তাদের বলেছেন, ফুল কেন মন্ত্রী ছিলাম, মন্ত্রী আছি।

মন্ত্রিসভার এই রদবদলে আলোচনার ঝড় যেখানে তুলেছে সেটি হলো সৎ-সাহসী, দক্ষ-পরিশ্রমী তারানা হালিমকে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে তথ্য মন্ত্রণালয়ে হাসানুল হক ইনুর সঙ্গে দেওয়া হয়েছে। শিক্ষামন্ত্রীর বিরুদ্ধে যেখানে প্রশ্নপত্র ফাঁসসহ ব্যর্থতার অভিযোগের পাহাড় সেখানে ভাগ বসাতে দেওয়া হয়েছে কেরামত আলীকে। টেকনোক্র্যাট কোটায় ডাক-টেলিযোগযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে বসানো হয়েছে তথ্যপ্রযুক্তিবিদ মোস্তাফা জব্বারকে।

মোস্তাফা জব্বার জাসদ করেছেন। বঙ্গবন্ধু পরিবার ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নানামুখী অপপ্রচারে লিপ্ত ও জাসদের মুখপত্র গণকণ্ঠে কাজ করেছেন। বাংলা সাহিত্যের ছাত্র মোস্তাফা জব্বার মুক্তিযুদ্ধই করেননি, কম্পিউটারে বাংলা ফন্ট বিজয়ের জনক হয়ে জনপ্রিয় হয়েছেন। কম্পিউটার ব্যবহারে মানুষের মধ্যে যে আগ্রহ তার নেপথ্যে তার সৃষ্টিশীলতা কাজ করেছে। ব্যক্তিজীবনে প্রাণ খোলা, বিনয়ী-অমায়িক ব্যবহারে সজ্জন মানুষ হিসেবে সবাইকে আপন করে নিতে পারেন। জীবনে প্রথম মন্ত্রী হিসেবে শপথ নিতে গিয়ে মুজিবকোট পরেছেন। এটি আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের নিঃসন্দেহে আনন্দের বিষয়।

ডিসেম্বরে হয় যদি জাতীয় নির্বাচন তাহলে নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হবে নির্বাচনকালীন রুটিন ওয়ার্ক করার জন্য। নির্বাহী ক্ষমতা নিয়ে এই মন্ত্রিসভার সময়কাল হয়তো আর ১০ মাস। পাঁচ বছরে যেখানে অনেকে সাফল্যের গৌরব অর্জন করতে পারেন না; সেখানে নতুন মন্ত্রীদের জন্য এ সময়টুকু কঠিন চ্যালেঞ্জের। মোস্তাফা জব্বার ইন, তারানা আউট যে আলোচনার জন্ম দিয়েছে তা হচ্ছে মন্ত্রণালয়ের ভিতরে বাইরে একটি শক্তিশালী চক্র দীর্ঘদিন ধরে তারানাকে সরিয়ে দিতে চেয়েছে।

তারা সফল হয়েছে। মন্ত্রী হয়েই মোস্তাফা জব্বার বলেছেন, তারানার সরে যাওয়ার কারণ ওপেন বলা যাবে না। জবাবে তারানা প্রশ্ন রেখেছেন, তাহলে কি তিনি সেই সিন্ডিকেটের কথা বলছেন, যারা তাকে সরাতে চেয়েছে? এখান থেকে তথ্য মন্ত্রণালয়ে সরিয়ে দেওয়ায় তারানার আর্তনাদ মৃদুমন্দ আলোচনার ঢেউ তুলেছে। মোস্তাফা জব্বারের আগমনে তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে জুনাইদ আহমেদ পলকের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে এত দিনের একক কর্তৃত্ব আর থাকল না। যদিও পলক এ নিয়ে কোনো অনুভূতি ব্যক্ত করেননি।

মোস্তাফা জব্বার বলেছেন, ডুবন্ত নৌকা জাগাতে প্রধানমন্ত্রী তাকে দায়িত্ব দিয়েছেন। বক্তব্য যদি মন্ত্রণালয় ঘিরে হয়ে থাকে তাহলে কি তারানা ও পলক ব্যর্থ থেকেছেন এ প্রশ্ন থেকে যায়। যদিও তারানা ও পলক একঘরে হয়েও অনেক চ্যালেঞ্জ সাফল্যের সঙ্গে অতিক্রম করেছেন। আর যদি সামগ্রিক প্রেক্ষাপট নিয়ে জাতীয় নির্বাচন সামনে নিয়ে বলে থাকেন তাহলে প্রশ্ন থাকে আগামীতে নৌকা কি ডুবন্ত? আওয়ামী লীগের নেতারা যেখানে বলছেন শেখ হাসিনার ইমেজ ও তার ব্যাপক উন্নয়ন-কর্মকাণ্ড, অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি অর্জনের পথে আগামীতেও ব্যালট বিপ্লবে নৌকা ভেসে যাবে, সেখানে তিনি নৌকা ডুবন্ত বলছেন কেন?

এর ব্যাখ্যা তিনিই দিতে পারবেন। মোস্তাফা জব্বার মানুষের মনের ভাষা পাঠ করে কিছু ইতিবাচক কথাও বলেছেন। সবচেয়ে বড় অগ্রাধিকার বলেছেন, মানুষের আকুতি গ্রহণ করে, সেটি হচ্ছে ইন্টারনেটের দাম কমানোই তার বড় চ্যালেঞ্জ। এবং টেলিটককে মুনাফা লোটার আগ্রাসনের মুখে জনপ্রিয় ও অধিক লাভজনক করার। এ প্রশ্ন মানুষের মধ্যে অনেক দিন। গ্রামীণফোন যেখানে একচেটিয়া বাজার দখল করছে, টেলিটক কেন সেখানে রাষ্ট্রীয় শক্তি থাকার পরও মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে।

রাশেদ খান মেননই নন, বিমানে যখন যিনি মন্ত্রী ছিলেন সততা ফিরলেও ব্যর্থতার দায়ভার বহন করতে হয়েছে। মাটিতে বিমান লোকসান গুনেছে। আকাশে সাধারণ যাত্রীই নয়, প্রধানমন্ত্রীকে নিয়েও ঝুঁকিতে পড়েছে। শাহজাহান কামাল একজন সৎ, গণমুখী ও সহজ-সরল রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচিত। আবেগাপ্লুত হয়েই হয়তো তিনি বলেছেন, বিমানকে লাভজনক করতে রক্ত দেবেন, তবু এশিয়ার অন্যতম জনপ্রিয় এয়ারলাইনসে পরিণত করবেন।

মানুষ মন্ত্রীদের কাছে অতিকথন শুনতে চায় না। বড় বড় কথার ওজন নিতে চায় না। চায় মন্ত্রণালয় পরিচালনায় তাদের দক্ষ ও শক্তিশালী নেতৃত্ব। চায় সততার সঙ্গে তারা যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখুন। সাফল্যের মুকুট উঠুক তাদের মাথায়। তারা সফল হলেই মানুষ সুখী। তারা ব্যর্থ হলেই মানুষ হতাশ। জনমনে অসন্তোষ।

তিন. বছরের শুরুতে ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে নিজেদের রক্ত ঝরেছে। দুই বড় দল বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে। ছাত্র সংগঠনগুলোর লাগাম টানতে বড় দুই দলের জন্য অগ্নিপরীক্ষা। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের দিবসে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে নয়াপল্টন দলীয় কার্যালয়ের সামনে কোথাও সমাবেশ করার অধিকার পাননি। ছাত্রদলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউশনে সমাবেশে যোগ দিয়েছেন। সেখানেও প্রথমে ভিতরে প্রবেশের তালা খুলে দেওয়া হয়নি। পরে দেওয়া হয়েছে। কেনই বা প্রথম বাইরে রাখা হলো, কেনই বা পরে ভিতরে ঢুকতে দেওয়া হলো, তার কারণ জানা যায়নি। এ ঘটনা সরকারের জন্য সুখকর নয়।

খালেদা জিয়া বক্তৃতায় যে কথাটি জোরের সঙ্গে বলেছেন, সরকারের উদ্দেশে ‘যত চেষ্টাই করুন, আমাদের বাইরে রেখে নির্বাচন করতে পারবেন না। আমাদের নিয়েই নির্বাচন করতে হবে।’ বিএনপি যে এবার নির্বাচনের ব্যাপারে সিরিয়াস এটি যেমন ফুটে উঠেছে তেমনি বিএনপিকে বাইরে রেখে নির্বাচন করতে গেলে খালেদা জিয়া যে প্রতিরোধ করতে যাবেন, সেই হুঙ্কারও তিনি দিয়েছেন।

তার এ বক্তব্য আরেক বক্তব্যে তলানিতে পড়ে যায়। তিনি বলেন, ‘পদ্মা সেতুতে কেউ উঠবেন না। সেটি জোড়াতালির সেতু। সেতু ভেঙে পড়ে যাবে।’ দেশের মানুষের প্রবল আগ্রহ লালন করেই বিশ্বব্যাংকের অসহযোগিতা দুর্নীতির অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণ করে শেখ হাসিনার সরকার যে চ্যালেঞ্জ নিয়ে পদ্মা সেতুর উন্নয়নকাজ দৃশ্যমান করেছে, সেখানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বেগম খালেদা জিয়ার অভিনন্দন জানানোর কথা। এভাবে পদ্মা সেতু নিয়ে আক্রোশ বা প্রতিহিংসার প্রকাশ গ্রহণযোগ্য নয়।

বিবেচনাপ্রসূত নয়। সাবেক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি ভালো করে জানার কথা জনগণের কল্যাণে সরকার উন্নয়ন প্রকল্প সম্পন্ন করবে। সেটি রাষ্ট্রীয় সম্পদ। পদ্মা সেতু নিয়ে যদি কোনো অনিয়ম-দুর্নীতি বা অব্যবস্থাপনা থাকে সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে সংবাদ সম্মেলনেই হোক আর সভা-সমাবেশেই হোক তা তিনি বলতে পারেন। কিন্তু জনগণের সম্পদ জনগণকে ব্যবহার করতে না করার অনুরোধ দায়িত্বশীল নেত্রীর কণ্ঠে মানায় না।

পদ্মা সেতুর জন্য সরকার ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। যমুনা নদীর ওপর বঙ্গবন্ধু সেতুর প্রকল্প এরশাদ নিয়েছেন। শেখ হাসিনা এ সেতুর কাজ শেষ করলেও এখানে খালেদা জিয়ার সরকারের অবদান রয়েছে। এ সেতু মানুষের দুর্ভোগ থেকেই মুক্তি দেয়নি, উত্তরবঙ্গের অর্থনীতির দুয়ার খুলেছে।

পদ্মা সেতু সম্পন্ন হলে মানুষের দুর্ভোগের অবসান ঘটবে। দক্ষিণের অর্থনীতির দুয়ারও খুলবে। বছরের শুরুতেই এমন বক্তৃতা ও রাজনীতির চিত্রপট বলছে, ‘মর্নিং শোজ দ্য ডে’। জানুয়ারিই বলে দিচ্ছে, ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে বছরের রাজনীতি মসৃণ পথে হাঁটছে না।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর