নৌকায় ওদের জন্ম নৌকায় ওদের মৃত্যু

হাওর বার্তা ডেস্কঃ সন্ধ্যা হলেই শত প্রদীপের আলোয় আলোকিত হয়ে ওঠে বুড়াগৌরঙ্গ নদীর তীর। গোধূলির শেষ লগ্নের লালবর্ণ আকাশ যেমন পাল্টে দেয় সন্ধ্যা তারায়। একইভাবে কৃত্রিম আলোর পশরায় মোহনীয় সন্ধ্যা নেমে আসে বঙ্গোপসাগরের মোহনায়। ক্লান্তি চোখ প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে নদীর পাড়ের দিঘল এই আলোর পশরায়। সমাজ ও সভ্যতা থেকে ছিটকে পড়া এই দারিদ্র্য জনগোষ্ঠীর নাম ‘মান্তা’। সর্বহারা কিংবা নিঃস্ব বলে সমাজে আখ্যায়িত হলেও-নিজেদের মান্তা জনগোষ্ঠী বলে দাবি করেন তারা। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন এলাকার নদী ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে এই পরিবারগুলো এখন বঙ্গোপসাগরের বিস্তীর্ণ এলাকায় বসবাস করছেন। জন্মসূত্রে বাংলাদেশের নাগরিক হলেও অন্যদের মতো মৌলিক চাহিদা মেটাতে অক্ষম এই জনগোষ্ঠী। পটুয়াখালীর জেলার বিচ্ছিন্ন বেশ কয়েকটি দ্বীপের মধ্য রাঙ্গাবালী উপজেলার চরমোন্তাজ ইউনিয়ন আরো একটি অন্যতম দ্বীপ। ৯০ ভাগ মানুষ কৃষি ও মৎস্য পেশায় নির্ভর। পটুয়াখালী জেলার শেষ এবং পূর্ব-দক্ষিণ প্রান্ত রাঙ্গাবালী উপজেলার বঙ্গোপসাগরের কূল ঘেঁষা চরমোন্তাজ ইউনিয়নের বুড়াগৌরঙ্গ নদীর তীরে এই দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বসবাস। কখন কোন ঋতু কিংবা বর্ষা মৌসুম- এমন হিসাব নিকাশ নেই পরিবারগুলোর। কাঠের তৈরি ছোট্ট একটি নৌকা নিয়ে স্থানীয় নদ-নদীগুলোতে মাছ শিকার করাই এদের মূল লক্ষ্য। নৌকায় শুধু মাছ ধরা নয়, নৌকায় জন্ম, নৌকায় শৈশব আর নৌকায় এদের মৃত্যু হয়। পরিবারের সবাই মিলে নৌকায় বসবাস করে আসছেন জন্ম থেকে। সারা দিন রোদে পুরে অথবা বর্ষায় কাক ভেজা দিয়ে সন্ধ্যায় ফিরে আসে বুড়াগৌরঙ্গ নদীর কিনারে। দিনভরের রোজগার দিয়ে সন্ধ্যায় চুলা জালায় নৌকার ছাউনিতে। রাতেই হয় ভোজন। এভাবেই বসবাস করে আসছেন ওই নদীর কিনারে শতাধিক মান্তা পরিবার। শিক্ষা বলতে বাবা-মায়ের সঙ্গে শিশু-কিশোরদের মাছ ধরা অথবা মাছ ধরার কাজে সাহায্য করা। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তো দূরের কথা, নেই স্বাস্থ্য সেবা অথবা পরিবার পরিকল্পনা এবং জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি জানেনা তারা। রোগবালাই সারতে যায় স্থানীয় কবিরাজ, বৈদ্যের কাছে। জন্ম সূত্রে বাংলাদেশি অথবা মুসলিম দাবি করলেও স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি থেকে রয়েছে তাদের প্রতি চরম অবহেলা। গ্রাম পর্যায়ে সরকার কর্তৃক বিভিন্ন সাহায্য দেয়া হলেও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা ভূমিহীন অথবা নদীতে বসবাসকারীদের জন্য কোনো সাহায্য দেয়া হয় না এমন অজুহাত দিয়ে তাড়িয়ে দেয়া হয় বলে অভিযোগ তাদের। কথা হয় তিন পুত্র সন্তানের জননী মান্তা জনগোষ্ঠী পরিবারের সদস্য রোকেয়া বেগমের সঙ্গে। তিনি জানান, পটুয়াখালী জেলার বাউফল উপজেলার কালাইয়া বন্দরের আদিবাসী ছিলেন। নদী ভাঙনে নিঃস্ব হয়ে শত বছর আগে তার পূর্ব পুরুষ চরমোন্তাজ ইউনিয়নের বুড়াগৌরঙ্গ নদীর কিনারে ঘাঁটি বাঁধে। তার পর থেকেই এই নদীর কিনারে তাদের বসবাস। বাবা সালাম সরদার ও মা রাহিমা অনেক আগেই মারা গেছেন। স্বামী আলতাব সরদার এবং শাকিব ও আখিদুল ও নাজিম নামে তিন সন্তান নিয়ে মাছ ধরেই জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন। শিক্ষা, পরিবার-পরিকল্পনা, জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি অথবা সমাজের বিন্দু সভ্যতা-আচারের ছোঁয়া লাগে না এদের গায়ে। সাগরের নোনা জল যেমন জীবন বাঁচায়, তেমনি সাগরের এক-একটি ঢেউয়ের সঙ্গে ক্ষয়ে যায় তাদের ছোট ছোট স্বপ্ন। শিশু দুই সন্তানও তাদের সঙ্গে মাছ ধরার কাজে সাহায্য করছেন। গ্রীষ্ম কিংবা শীত নেই। দিনরাত মাছ ধরে বাজারে বেচে দিয়ে সওদা করতে হবে, এমন চিন্তা ছাড়া সমাজের ন্যূনতম সভ্যতা-আচার জানেনা তারা। এসময় আরো কথা হয় মান্তা পরিবারের সদস্য পারুজান বিবির (৪০) সঙ্গে। রুবেল, সোহেল, জুয়েল, খলিল, জামুজান এবং লিপিসহ ছয় সন্তানের মা তিনি। অন্যদের মতো জাল নেই তার। বড়শি দিয়ে মাছ ধরেন তিনি। ছয় সন্তান নিয়ে ছোট্ট একটি নৌকার ছাউনিতে সকলের বসবাস। অর্থ সংকটে জাল কেনা হয়নি তার। তাই আয়-রোজগার কম। কিন্তু পরিবারের সদস্য সাত জন। এভাবেই চরমোন্তাজের বুড়াগৌরঙ্গ নদীর কিনারে শতাধিক নৌকায় নারী-পুরুষ, শিশুসহ অন্তত পাঁচ শতাধিক মানুষের বসবাস। মৌলিক চাহিদা বলতে সাগরের নোনা জলে গোসল করা এবং মাছ ধরে চরমোন্তাজের বাজারে বেচে দিয়ে চাল-ডাল কিনে পরিবার নিয়ে বেঁচে থাকা। এভাবেই শত শত শিশুর জন্ম হয়েছে কাঠের নৌকার ছাউনিতে। সমাজের ন্যূনতম আচার-সভ্যতা ছাড়াই বেড়ে ওঠে এই পরিবারের সদস্যরা।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর