কোন পথে বিএনপি

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের গাড়িবহরে হামলার পর বিএনপি বেশ নিয়ন্ত্রিত প্রতিক্রিয়া  দেখিয়েছে। এটি কতটা সাংগঠনিক অক্ষমতা আর কতটা কৌশলগত তা নিয়ে কথা আছে। তবে ইতিবাচকভাবেই দলটি কোনো সহিংস কর্মসূচিতে যায়নি। কোথাও ভাঙচুরের কোনো ঘটনা ঘটেনি। নিয়মতান্ত্রিক বিক্ষোভের চেষ্টা করেছেন বিএনপি নেতাকর্মীরা। এ ঘটনায় আওয়ামী লীগ নেতা হাছান মাহমুদের বক্তব্য ও ভূমিকা দু’টিরই সমালোচনা হয়েছে। তবে আওয়ামী লীগের অনেক শীর্ষস্থানীয় নেতাই বেশ ইতিবাচক বক্তব্য দিয়েছেন। ওবায়দুল কাদের এবং মোহাম্মদ নাসিম এ হামলার নিন্দা জানিয়েছেন। দোষীদের বিচারের মুখোমুখি করার কথাও বলেছেন তারা। যদিও এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তারের খবর পাওয়া যায়নি।
জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর বিএনপি টিকবে কি-না সে প্রশ্ন উচ্চকিত হয়েছিল। গৃহবধূ থেকে রাজনীতিবিদ বনে যাওয়া বেগম জিয়া দক্ষতার সঙ্গে পরিস্থিতি সামাল দিয়েছিলেন। কিন্তু গত এক দশকে বিপর্যয়কর পরিস্থিতি উত্তরণে বিএনপিতে দক্ষ নেতৃত্ব দেখা যায়নি। অনেক পর্যবেক্ষকই বলেন, বর্তমানে বিএনপি অনেকটা হাফটাইম পলিটিক্স করছে। এ ধরনের রাজনীতি দিয়ে পরিস্থিতি উত্তরণ কঠিন। এই দীর্ঘ সময়ে বিএনপি’র নেতৃত্বের ভুল-শুদ্ধ নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। অপারেশনের টেবিলে কাটাছেঁড়া হয়েছে বহু। অনেক ত্যাগও স্বীকার করতে হয়েছে দলটিকে। দলের দ্বিতীয় প্রধান নেতা দেশ এবং দল থেকে বিচ্ছিন্ন। কিন্তু এতোকিছুর পরেও রাজনীতি থেমে নেই। সামনের দিনে নিজেদের রাজনীতি কেমন হবে তা নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য বিএনপি’র সামনে হয়তো খুব বেশি সময়ও নেই।
বিএনপি কি আবারো আন্দোলন কর্মসূচিতে যাবে? বিএনপি কি মাঠে নামতে পারবে? সহিংস না অহিংস কেমন হবে সে কর্মসূচি? বিএনপি’র কোনো দাবি কি পূরণ হবে? শেখ হাসিনার অধীনে কি বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে? কেমন হবে সে নির্বাচনের ফল। বাংলাদেশে নির্বাচনী রাজনীতিতে সিদ্ধান্ত নেয়া খুবই কঠিন। কখন পরিস্থিতি কোন্‌ দিকে মোড় নেয় তা আগে থেকে বলা মুশকিল। এরশাদের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার খালেদা জিয়ার সিদ্ধান্ত সঠিক হিসেবেই ইতিহাসে প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন বর্জনের জন্য খালেদা জিয়া এবং তার দলকে যথেষ্ট মূল্য দিতে হয়েছে এবং হচ্ছে। নির্বাচনে অংশ নিলে পরিস্থিতি কি ভিন্ন কিছু হতো- এ নিয়ে বিতর্ক আছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর আলোচনার আহ্বানে সাড়া না দেয়ার খালেদা জিয়ার সিদ্ধান্ত যে ভুল ছিল তা নিয়ে খুব বেশি বিতর্ক নেই। ওই সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে খালেদা জিয়া দলের কোনো পর্যায়ে কোনো বৈঠকও করেননি।
বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে জোট প্রশ্নেও বিএনপি’র সামনে সিদ্ধান্ত নেয়ার বিষয় রয়েছে। নিজস্ব প্রতীকে আগামী নির্বাচনে জামায়াতের অংশ নেয়ার সুযোগ নেই। কাছাকাছি সময়ে অনুষ্ঠিত স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে বিএনপি জামায়াতকে তেমন গুরুত্ব দেয়নি। ২০ দলীয় জোট প্রার্থীর প্রচারণার জন্য গঠিত টিমে জামায়াতের কোনো সদস্য রাখা হয়নি। নারায়ণগঞ্জ ও কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে এ দৃশ্য ছিল একেবারেই পরিষ্কার। ২০ দলীয় জোটে জামায়াতের ভূমিকাও অনেকটা অকার্যকর। জামায়াতকে জোট থেকে বাদ দিতে অনেকদিন থেকেই খালেদা জিয়ার ওপর দেশি-বিদেশি চাপ রয়েছে। তিনি অবশ্য এতোদিনেও এ ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নেননি। টানাপড়েন থাকলেও বিএনপি-জামায়াতের মধ্যে যোগাযোগ রয়েছে বলে জানা যাচ্ছে। তবে আগামী নির্বাচন প্রশ্নে দল দু’টির মধ্যে কী ধরনের সমঝোতা হয় সেদিকে খেয়াল রাখছেন পর্যবেক্ষকরা। ২০০১ এবং ২০০৮ সালের আদলে প্রকাশ্য জোট কাঠামোতে তারা নির্বাচনে অংশ নেন, নাকি অন্য কোনো ফর্মুলা অবলম্বন করেন সে ব্যাপারেও বিএনপিকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অপেক্ষাকৃত প্রগতিশীল কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বিএনপি ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ গড়ে তুলতে চাইলেও ওই প্রক্রিয়া বেশিদূর এগোয়নি। হেফাজত সংশ্লিষ্ট দলগুলোকে বিএনপি জোট থেকে আলাদা করার এক ধরনের প্রক্রিয়াও চলমান রয়েছে।
৫ই জানুয়ারি নির্বাচনকেন্দ্রিক বিএনপি’র সহিংস রাজনীতির সমালোচনা হয়েছে অনেক। এ সময় বিএনপি’র হাজার হাজার নেতাকর্মীকে মামলা আর গ্রেপ্তারেরও মুখোমুখি হতে হয়েছে। গুম, খুন আর ক্রসফায়ারের শিকারও হয়েছেন অনেকে। এখনো বিএনপিকে ওই মূল্য পরিশোধ করতে হচ্ছে। গ্রেপ্তার হওয়া নেতাকর্মীদের প্রায় সবাই পরে জামিনে মুক্তি পান। কিন্তু এখনো প্রতিনিয়ত তাদের আদালতে হাজিরা দিতে হচ্ছে। এসব মামলার রায় কী হবে তা নিয়ে বিএনপি’র ভেতরে রয়েছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। দলীয় প্রধান থেকে শুরু করে তৃণমূল নেতা পর্যন্ত এমন নেতার সংখ্যা একেবারেই কম যাদের বিরুদ্ধে মামলা নেই। সম্ভাব্য প্রার্থীরাও চিন্তায় রয়েছেন- মামলার রায় বিরুদ্ধে গেলে তারা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন কি-না? ব্যবসা-বাণিজ্যসহ নানা ক্ষেত্রেই বিএনপি’র নেতাকর্মীদের প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। এসব প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করে টেকাই দায় হয়েছে বিএনপিপন্থি ব্যবসায়ীদের। এরই মধ্যে এখন আবার পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে বিএনপি’র অর্থদাতাদের ব্যাপারে খোঁজ নেয়া হচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতে ঈদের পর নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের ফর্মুলা উপস্থাপন করার কথা রয়েছে বিএনপি নেত্রীর। তবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এরই মধ্যে এই ধরনের সরকারের সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, সংবিধানে এই ধরনের সরকারের কোনো ব্যবস্থা নেই। পৃথিবীর কোথাও এ ধরনের সরকারের কোনো উদাহরণ নেই। এখন প্রশ্ন হচ্ছে- সরকার যদি বিএনপি’র প্রস্তাবে সাড়া না দেয় তবে দলটি কোন্‌ পথে যাবে। নতুন করে কোনো আন্দোলন-কর্মসূচি গড়ে তোলার সামর্থ্য দলটির আছে কি-না এ নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। যদিও বিএনপি’র একটি অংশ সীমিত পর্যায়ে হলেও ফের আন্দোলনে যাওয়ার পক্ষে। ওই অংশটি মনে করে, আন্দোলন ছাড়া কোনো দাবি আদায় করা সম্ভব নয়। সহসাই সীমিত কর্মসূচি নিয়ে হলেও বিএনপি রাজপথে নামতে পারে বলে দলটির একটি সূত্রে জানা গেছে। তবে আন্দোলনের সফলতা সম্পর্কে বিএনপি নেতৃত্বের অনেকেই সন্দিহান। তারা মনে করেন, আবার যদি আন্দোলনে নেমে ব্যর্থ হতে হয় তাহলে দলের নেতাকর্মীরা নতুন করে চাপে পড়বে। এতে নির্বাচনেও তারা কোনো ভূমিকা রাখতে পারবেন না। আন্দোলনের  চেয়ে আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানোর পক্ষে মত তাদের। তারা মনে করেন, ভারত কিছুটা নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকলে সরকার আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর চাপে নিরপেক্ষ নির্বাচন দিতে বাধ্য হবে। ভারতের রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে বিএনপি’র একটি অংশের যোগাযোগ থাকলেও আমলাতান্ত্রিক অংশ বিএনপিকে কোনো ধরনের সুযোগ দেয়ার পক্ষে নয় বলে আলোচনা রয়েছে।
প্রার্থী বাছাই নিয়েও বিএনপি’র সামনে চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অবশ্য বলছেন, দলে নয়শ’ প্রার্থী প্রস্তুত রয়েছেন। নির্বাচনকে সামনে রেখে সংস্কারপন্থি কয়েকজন নেতাকেও এরই মধ্যে বিএনপিতে ভেড়ানো হয়েছে। বাকি যে সংস্কারপন্থিরা রয়েছেন, তাদেরও ক্রমান্বয়ে দলে ভেড়ানো হবে। তবে এরপরও তিন শ’ আসনে শক্ত প্রার্থী পেতে সমস্যায় পড়তে হতে পারে বিএনপিকে।
বেগম খালেদা জিয়ার মামলা ঘিরেও বিএনপিতে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা রয়েছে। তার দু’টি মামলা অন্তিম পর্যায়ে। এসব মামলার রায় বিপক্ষে গেলে খালেদা জিয়া নির্বাচনে অযোগ্যও ঘোষিত হতে পারেন। এক্ষেত্রে বিএনপিকে নেতৃত্বের সংকটেও পড়তে হতে পারে। অতীতে খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমান কারাগারে থাকার সময় বিএনপিতে এক ধরনের যৌথ নেতৃত্ব দেখা গেছে। মান্নান ভূঁইয়া সংস্কারপন্থি হলেও খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন নেতৃত্বের প্রতি অকুণ্ঠ বিশ্বাস বহাল রেখেছিলেন। এবারও পরিস্থিতি উদ্ভব হলে যৌথ নেতৃত্বে দল পরিচালনার সম্ভাবনাই বেশি। কারণ তারেক রহমান অনুপস্থিত। জোবায়দা রহমানেরও দেশে ফিরে রাজনীতিতে যোগ দেয়ার সম্ভাবনা কম। যদিও বিএনপি’র এক নেতা এ প্রতিনিধির কাছে দাবি করেছেন, পরিস্থিতি তৈরি হলে জোবায়দা রাজনীতিতে আসতে পারেন।
সামনের দেড় বছর রাজনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কয়েকমাস পরেই হয়তো রাজনীতি আবার নাটকীয় মোড়ে যেতে পারে। বিএনপি’র ভাগ্য কি বদলাবে? খালেদা জিয়া কি চালে এগুতে পারবেন। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, আপাতত মিরাকলের জন্য অপেক্ষা করছে খাদের কিনারায় থাকা দলটি।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর