কিশোরগঞ্জের ‘নরসুন্দা লেকসিটি’ প্রকল্প : ফুটব্রিজগুলো যেন মরণফাঁদ

জাহাঙ্গীর কিরণ:নদীতে প্রবাহিত হবে স্বচ্ছ-নীলাভ জল। শান্ত-শীতল বাতাস ছুঁয়ে দেবে গভীর প্রশান্তি। পাড়ে বসে পানির কলতান শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে যাবে ক্লান্ত পথিক। নদীর দুই পাড় ঘেঁষে নির্মিত ফুটওয়ে এবং ফুটব্রিজগুলো নগরবাসীর প্রাণে দোলা দেবে। পাখির কলরবে মুখরিত থাকবে এই আঙিনা। তাদের সঙ্গে মিতালী করতে উচ্ছল শিশু-কিশোররা ছুটবে এপার থেকে ওপার।
প্রায় ১১০ কোটি টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়নাধীন নরসুন্দা নদী পুনর্বাসন ও পৌরসভা সংলগ্ন এলাকার উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ শুরু হওয়ার পর এমন একটি ‘লেকসিটি’র স্বপ্ন বোনেন কিশোরগঞ্জবাসী। ২০১২ সালে শুরু হওয়া প্রকল্পটির মেয়াদ ফুরিয়ে এসেছে। এরই মধ্যে লেকসিটি গড়ার কাজও প্রায় শেষ। কিন্তু যেটা হয়েছে সেটাকে কি লেকসিটি বলা যায়! কিশোরগঞ্জবাসী অবশ্য এটির নামকরণ করেছেন মৃত্যুফাঁদ। ফুটওয়ের ইট আর পাড়ের ব্লকগুলো ধসে পড়ছে হরহামেশাই। ফুটব্রিজগুলোর কোনো সংযোগ পথ নেই। এখান থেকে মূল সড়কে উঠতে হয় মই দিয়ে আর নামতে হয় লাফ দিয়ে। শহর এলাকায় নদীর দুই পাশ ঘুরলেই বোঝা যায় অপ্রয়োজনীয় ও অপরিকল্পিত কাজ করে টাকা হাতিয়ে নেয়াটাই ছিল দায়িত্বশীলদের প্রধান লক্ষ্য।
প্রকল্প এলাকা সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা গেছে, পৌর এলাকায় নদীর ওপর চারটি ফুটব্রিজ নির্মাণ করা হয়েছে। যা দিয়ে এপার থেকে ওপারে পারাপার করা যায়। কিন্তু এসব ব্রিজ থেকে মূল সড়কে নির্মিত সংযোগ ব্রিজগুলোর কোনো সমন্বয় নেই। ফুটওয়ে থেকে ফুটব্রিজ পার হয়ে মূল সড়কে উঠতে হলে পথচারীকে অবশ্যই মই দিয়ে উঠতে হবে। আর নামতেও হবে একই পন্থায়। ব্রিজগুলো নির্মাণ হওয়ার পর শহরবাসী করছেনও তাই। বিশেষ করে স্কুল-কলেজ পড়–য়া শিক্ষার্থীরা এসব ব্রিজ ব্যবহার করতে গিয়ে নিজের জীবনটাকেই বাজি কিশোরগঞ্জের ‘নরসুন্দা লেকসিটি’ প্রকল্প : ফুটব্রিজগুলো যেন মরণফাঁদ!রাখছেন। মাটিতে হাত চাপিয়ে এমনকি লাফ দিয়ে ওঠা-নামা করতে গেছে তাদের। এটি করতে গিয়ে অনেকে আছড়ে পড়ে আঘাতপ্রাপ্তও হয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
নরসুন্দা লেকে বেড়াতে আসা বেশ কয়েকজন এই প্রতিবেদকে অভিযোগ করে বলেন, কিশোরগঞ্জে বিনোদনের স্পট খুব একটা নেই। এখন যেটি হয়েছে সেটিও মৃত্যুকূপ। এত টাকা খরচ করে ব্রিজগুলো নির্মাণ করা হয়েছে, অথচ একটিরও সংযোগ রাখা হয়নি। তারা প্রশ্ন রেখে বলেন, ব্রিজগুলো যদি নগরবাসীর কোনো কাজেই না আসে তাহলে এসব করা হলো কেন?
এর কোনো সদুত্তর নেই প্রকল্পের তদারকি কর্মকর্তা কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলা প্রকৌশলী শাহ আলমের কাছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে মানবকণ্ঠকে তিনি বলেন, এটি প্রকৌশলীদের কোনো বিষয় নয়। যারা প্ল্যান করেন তারাই এ বিষয়ে চিন্তা করবেন। প্রকৌশলীদের কাজ প্ল্যান অনুযায়ী কাজটি সম্পন্ন করা। তাই করা হচ্ছে। তবে সংযোগের ব্যবস্থা করা হলে ভালো হতো।
কিশোরগঞ্জের নরসুন্দা লেকসিটি প্রকল্পটি নিয়ে শুরু থেকেই অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ ছিল শহরবাসীর। এ নিয়ে ‘এমন তো কথা ছিল না’ শিরোনামে মানবকণ্ঠে একটি সচিত্র প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়। এতে কিশোরগঞ্জের বিশিষ্ট ব্যক্তিরাসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের অভিযোগ তুলে ধরার পরও সংশ্লিষ্টদের টনক নড়েনি। আগের মতোই গায়ে হাওয়া লাগিয়ে তারা ঘুরছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। তাদের এই দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজের প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠেছে কিশোরগঞ্জবাসী। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। অনেককে বিভিন্ন ধরনের মন্তব্য করতেও গেছে।
শহরের যশোদল এলাকার মুজিবুল হক কাইয়ুম নামে এক প্রতিবাদী যুবক মন্তব্য করেছেন, ‘এমন তো আমাদের আশা ছিল না’। উৎপল লুহ মন্তব্য করেছেন- ‘কেউ কথা রাখেনি’। তানিয়া ইসলামের মন্তব্য- ‘মানুষ লোভী, অর্থের জন্য নিজের দেশের সম্পদ নষ্ট করে দেয়’। সৈয়দ এনামুল আজিম মন্তব্য করেছেন- ‘আমরা সব অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার প্রতিবাদ করছি। সেইসঙ্গে নরসুন্দার কাক্সিক্ষত সৌন্দর্য দ্রুত ফিরিয়ে আনার আন্দোলনে সবাইকে সম্পৃক্ত হওয়ার অনুরোধ করছি’। রফিকুল আলম সিদ্দিকীর মন্তব্য- ‘ক্ষমতার নাকের ডগায় চাকু ঘোরানো শুধু কিশোরগঞ্জেই সম্ভব’। এমন শত শত মন্তব্য এসেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
এ বিষয়ে নাগরিক অধিকার সুরক্ষা মঞ্চের আহ্বায়ক ও কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান শেখ সেলিম কবির বলেন, ব্রিজগুলো দৃষ্টিনন্দন হলেও এটি একেবারেই অপ্রয়োজনীয়। এগুলো কোনো কাজেই লাগবে না। তবে সংযোগ রাখা হলে কিছুটা হলেও উপকৃত হতো মানুষ। প্রকল্পের প্ল্যানে এসব ছিল না। শুধু টাকা হাতিয়ে নেয়ার জন্যই পরে এগুলো করা হয়েছে। তিনি অভিযোগ করে বলেন, প্রকল্পের সব কাজেই অনিয়ম হয়েছে। নদীর খনন যতটুকু করার ছিল ততটুকু তো করাই হয়নি; উপরন্তু নদীর পাড়ের ঢাল, গভীরতা ও প্রস্থতার কোনো মেজারমেন্ট তারা ঠিক রাখেনি। পাড়ের মাটি শক্ত না করে ব্লক বসিয়ে দেয়া হয়েছে। যে কারণে কাজ শেষ না হতেই ব্লকগুলো পড়ে যাচ্ছে। পানির নিচে কোনো ব্লকই দেয়া হয়নি। ব্রিজগুলোর দৈর্ঘ্যও কমিয়ে দেয়া হয়েছে।
কিশোরগঞ্জ প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি একে নাছিম খান বলেন, প্রকল্পটির কাজ শুরু হওয়ায় সবাই আশাবাদী হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু কাগজে যা দেখানো হয়েছে তার বাস্তবায়ন হয়নি। নদীর খনন কাজ ও তীর রক্ষায় পুকুরচুরি করা হয়েছে। ব্রিজ, ওয়াকওয়ে, ওয়াচ টাওয়ারসহ দৃশ্যমান কাজগুলোও সঠিকভাবে করা হয়নি। নি¤œমানের কাজ করায় এখনই বিভিন্ন স্থান ভেঙে যাচ্ছে।
এ বিষয়ে প্রকল্পের তদারকি কর্মকর্তা শাহ আলমবলেন, কোয়ালিটি এবং কোয়ান্টিটি সঠিক রেখেই প্রকল্পের প্রতিটি কাজ সম্পন্ন করা হচ্ছে। এলাকাটি জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশারফুল ইসলাম এবং রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের হওয়ায় কাজের প্রথম থেকেই এ বিষয়টি মাথায় ছিল। এখানে অনিয়ম করার কোনো সুযোগ নেই। উত্থাপিত অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে তিনি বলেন, যারা প্রকল্পের অনিয়মের ব্যাপারে কথা বলছেন তারা সবাই সাধারণ মানুষ। এ বিষয়ে অভিজ্ঞ নন। কিছু না জেনে-বুঝেই তারা অভিযোগগুলো করছেন। নিজেকে নির্লোভ দাবি করে এই প্রকৌশলী বলেন, টাকার কোনো মোহ কখনো ছিল না, এখনো নেই। লক্ষ্য একটাই, কাজটি সঠিকভাবে শেষ করা। মানবকণ্ঠ

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর