কন্যার দিকে তাকিয়ে মৃত শাকিল বিতর্ক বন্ধ হোক

শাকিলের মৃত্যুকে ঘিরে আওয়ামীলীগের ভেতরে বাইরে অনেকেই শোকে স্তব্ধ ।এই অকাল আকস্মিক মৃত্যুর জন্য কেউ প্রস্তুত ছিলোনা। না পরিবার,না তার বন্ধু স্বজন,না তার রাজনৈতিক সতীর্থরা। পুরো শহরটা জুড়ে পরিচিত অপরিচিত জনের নানা জল্পনা-কল্পনা, আফসোস আর কৌতূহল ডাল পালা ছড়াচ্ছে । কল্পনাবিলাসী শাকিল নিজেকে সসময় আলোচনায় রাখতে পছন্দ করতো। সৃষ্টিকর্তা ওকে মেধা আর মাধুর্য দিতে কার্পণ্য করেননি বিন্দুমাত্র। তাই যে কারো হৃদয়ের মনি কোঠায় জায়গা করে নিতে পারতো নিমিষেই। ছেলেটি ছিল আপাদমস্তক রোম্যান্টিক একজন কবি মনের মানুষ । শাকিলের জানাজায় সবাই যে ভাবে কাঁদছিল দেখে মনে হয়েছিল, ঈশ শাকিল নিজে যদি তা একবার অন্তত দেখতে পেত!

পৃথিবীর সব মানুষ এক রকম ভাববে, চিন্তা করবে, জীবন কাটাবে এমন কোন বাঁধা ধরা নিয়ম নেই। কিন্তু তবুও আমরা সাধারণ মানুষেরা সবাইকে গণ্ডী বদ্ধ ছকে ফেলার চেষ্টা করে, জীবনের ফর্মুলা মেলানোর চেষ্টায় মত্ত হই। ভুলে যাই প্রতিটি মানুষ আলাদা সত্ত্বা, আলাদা হিসেবের খাতা । বেশীরভাগ মানুষের চাওয়া- পাওয়া এক এবং অভিন্ন। কিন্তু ব্যতিক্রম থাকবে না, তা কি করে হয়। এই ব্যতিক্রম তথা প্রথা ভাঙ্গা মানুষ গুলোই মূলত সৃষ্টিশীল। সৃষ্টিশীল মানুষদের সুখ, দুঃখ, বেদনা, প্রাপ্তি অন্য সবার বোধগম্য না হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু প্রথা বিরোধী মানুষেরা কখনও কখনও অতিরিক্ত কল্পনা প্রবণ হয়ে নিজের রচিত স্বপ্নরাজ্যে বাস করে। চারিপাশের মানুষ এবং জগত তাঁদের আকর্ষণ করে না। শুরু হয় মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব। ওর এ ধরণের কোন দ্বন্দ্ব ছিল কিনা আমার জানা নেই।

শাকিলের ফেসবুক স্ট্যাটাস, ওর জানাজায় এবং গত কয়েক দিনের ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার আলোকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে মৃত্যু চিন্তা ওকে ক্রমাগত তাড়া করে ফিরত। ওর পরিচিত সার্কেলে সবাইকে ও’ অনুরোধ করেছে ,” ওর মৃত্যু পরবর্তী সময়ে ওকে নিয়ে লিখতে নয় বলতে”। মৃত্যুর দিন সাতেক আগে নিজ হাতে রান্না করে নিকটতম বন্ধুদের সামদাদতে খাইয়ে বলেছে, ” সবাই পরে খাওয়ায় আমি আগে খাওয়াচ্ছি” । ভীষণ কষ্টকর প্রতিটি কথা, প্রতিটি মুহূর্ত ! মানুষটাকে সত্যিই হয়তো ভীষণ দুঃসহ সময়ের ভিতর দিয়ে কালাতিপাত করতে হয়েছে যা আমাদের মত সাধারণের চিন্তার বাইরে।

শাকিলকে আমি ব্যক্তি স্বার্থ, লোভ- লালসা, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির সাধারণ হিসেবের খাতায় তুলতে চাই না। মানুষ তখনই মৃত্যু কামনা করে যখন জীবনটাকে অসহ্য লাগে বোঝা মনে হয় ! তখন মৃত্যুর মাধ্যমেই মুক্তির সন্ধান করে। শাকিল সমস্ত হিসেব- নিকেশ, লাভ- ক্ষতি, সবার ধরা-ছোঁয়ার বাইরে অন্য এক জগতের বাসিন্দা এখন । এই পৃথিবীর কোন কান্নাই ওকে আজ স্পর্শ করবে না হয়তো। চারিদিকে এতো হট্টগোল, এতো হাহাকার জীবনের বাস্তবতায় সবই ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে আসবে একদিন । কিন্তু ওকে ঘিরে ওর প্রিয়তম যে চার নারী তাঁরা সান্ত্বনা পাবে কি করে ! ওর বৃদ্ধা মা, কাঁদতে কাঁদতে চোখে ছানি পরে যাবে একদিন । কিশোরী কন্যা মৌপি, বাবাহীন পৃথিবীতে ওর সমস্ত আবদার, অনুযোগ শূন্যে মিলিয়ে যাবে নরম গাল বেয়ে পরা লবণাক্ত জলের সাথে । ওর রূপবতী স্ত্রী পপি, স্বামী হীন পৃথিবীটাকে বড় বেশী রুক্ষ, শুষ্ক, নিষ্ঠুর বলে মনে হবে প্রতিটি পলে । সেই সাথে ভালোবাসা হীনতা হয়তো তাঁকে তাড়া করে ফিরবে চিরকাল । ফেসবুক স্ট্যাটাসে শাকিলের শেষ ভালবাসার সেই এলা, যত সন্দেহ আর ঘৃণার তীরে ক্ষত-বিক্ষত করুক, প্রশ্ন বানে জর্জরিত হোক, বিপর্যস্ত হোক ভ্রুক্ষেপ নেই, একা একা গুমরে গুমরে চার দেওয়ালের মাঝে কেঁদে ফিরবে কেবলই । দেওয়াল ভেদ করে সেই শব্দ কারো কানে এসে পৌঁছাবে না কখনোই । অন্তহীন কান্না আর দীর্ঘশ্বাস কেবল এই চার নারীর সঙ্গী হয়ে রইল ।

শাকিল সকলের আপন, সকলের আদরের কিন্তু নিজের বাবা-মা, স্ত্রী , সন্তান এমন কি ভালবাসার এলা কেও দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে গেল। মানুষ পরিবার তথা সমাজবদ্ধ প্রাণী । প্রতিটি মানুষ পরিবার, সমাজ এবং দেশ গঠনে কোন না কোন ভাবে নিজের অবদান রাখার চেষ্টা করবে এটাই নিয়ম। আর শাকিলের মতো মেধাবী, রুচিশীল, সংস্কৃতিমনা, রাজনীতি সচেতন, জনপ্রিয় নেতার কাছ থেকে মানুষ অনেক বেশী কিছু আশা করে। অনেক কিছু দিতেও পারতো হয়ত সে, অথচ নিষ্ঠুর নিয়তির কাছে অকালে হার মেনে চলে যেতে হল । জীবন হয়তো এমনই , ডাক এলেই চলে যেতে হয়, সময় অসময় কিছুই মানে না।

কিন্তু ওর মৃত্যু পরবর্তী যে সব নোংরা স্ট্যাটাস মৃত শাকিল কে বিতর্কিত করতে চাচ্ছে তাঁদের কাছে সবিনয়ে অনুরোধ, আমার বা আপনার কথায় একজন মৃত ব্যক্তির কিছুই আসে যায় না কিন্তু তাঁর শোক সন্তপ্ত পরিবার তাঁর একমাত্র কন্যা সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে এই বিতর্ক অচিরেই বন্ধ হোক।

খুজিস্তা নূর ই নাহারিন মুন্নী লেখক:সহ-সভাপতি, ব্রোকারেজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সহ-সভাপতি, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ; উপদেষ্টা সম্পাদক, পূর্বপশ্চিমবিডি.নিউজ

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর