একাশিতে পা দিলেন বর্ষীয়ান আইনজীবী ড. কামাল হোসেন

কিংবদন্তি আইনজীবী। বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির প্রধান। রাজনীতিক ড. কামাল হোসেনের আজ ৮০তম জন্মদিন। ১৯৩৭ সালের ২০শে এপ্রিল কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে রাজনীতিতে এসে বঙ্গবন্ধুরই ছেড়ে দেয়া তেজগাঁও আসন থেকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ১৯৭০-এর নির্বাচনে এমপি নির্বাচিত হন তিনি। ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য আগরতলা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারত যান। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের পরিবর্তে পাকিস্তান গিয়ে আইন ব্যবসা শুরু করেন। কয়েক মাস পর পাকিস্তান সরকার তাঁকে গ্রেপ্তার করে। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর ১৯৭২-এর ৮ই জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তাঁকেও মুক্তি দেয়া হয়। তিনি শেখ মুজিবের সঙ্গে ১০ই জানুয়ারি লন্ডন হয়ে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান রচনা কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭২ সালে প্রথমে আইনমন্ত্রী ও পরে ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বিশ্বের অন্যতম কনিষ্ঠ পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে জাতিসংঘে উড়িয়েছেন লাল-সবুজে খচিত বাংলাদেশের রক্তিম পতাকা। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ অর্জন করে জাতিসংঘের স্বীকৃতি। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের পর পাঁচ বছর লন্ডনে স্বেচ্ছানির্বাসন কাটিয়েছেন তিনি। ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে অংশগ্রহণ করেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে। আওয়ামী লীগের রাজনীতি থেকে বেরিয়ে তিনি গঠন করেন নতুন রাজনৈতিক দল গণফোরাম। বাংলাদেশের রাজনীতিতে সর্বদাই সোচ্চার তিনি। ব্যক্তিগত সততা, ন্যায্যতা, মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের প্রবক্তা হিসাবে খ্যাতি রয়েছে তার। ২০০৫ সাল থেকে দেশের রাজনীতিতে একটি ঐক্য গড়ার চেষ্টা করছেন তিনি। গঠন করেছিলেন জাতীয় ঐক্যের মঞ্চ। ২০১৪ সালে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে একটি রাজনৈতিক বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ড. কামাল আওয়ামী লীগের রাজনীতি ছেড়েছেন বহু আগেই। কিন্তু এখনও বঙ্গবন্ধুর প্রতি তার শ্রদ্ধাবোধ অটুট। ২০১৬ সালের মে মাসে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ করি, এখনও করি’। কারাভোগ করেছেন দুইবার। প্রথমবার মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পশ্চিম পাকিস্তানের মিয়াওয়ালি কারাগারে ৯ মাস। পরে স্বৈরাচার এরশাদ আমলে। ভোটার তালিকা সংশোধন নিয়ে আন্দোলন করতে গিয়ে আসামি হয়েছেন দেশদ্রোহিতার মামলায়।
জ্বালানি খাতে বিশ্বব্যাপী ড. কামাল হোসেন একজন সুপরিচিত সালিশ নিষ্পত্তিকারী। একে ব্রোহির জুনিয়র হিসেবে তার জীবনের প্রথম বড় মামলা ইত্তেফাক বনাম রাষ্ট্র মামলা। মালয়েশিয়া বনাম সিঙ্গাপুর সাগর ভরাট মামলার সফল সমঝোতায় তিনি ছিলেন অন্যতম সালিশ। জার্মান তেল কোম্পানির সঙ্গে বিরোধে তিনি কাতারকে করেন বিজয়ী। গায়ানা বনাম সুরিনাম সমুদ্রসীমা-সংক্রান্ত যে বিরোধের অন্যতম বিচারক ছিলেন তিনি। ১৯৭৬ থেকে ১৯৯৮ সালের মধ্যে কামাল হোসেন সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, সুইডেন, ডেনমার্ক, চীন, মোজাম্বিক, ত্রিনিদাদ ও টোবাগো, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইনের টেলিযোগাযোগ ও জ্বালানি তেল-সংক্রান্ত বিভিন্ন আইন প্রণয়নে সহায়তা দেন। বাংলাদেশের পক্ষে ড. কামাল হোসেন সিমিটারের বিরুদ্ধে মামলায় সাফল্য আনেন। চট্টগ্রাম বন্দরকে ১৯৮ বছরের জন্য ইজারা দেয়ার চেষ্টা আদালতের মাধ্যমে ঠেকান। তিয়াত্তরে শেলের কাছ থেকে নামমাত্র দামে গ্যাসের বিশাল মজুদ কেনার গর্বের ভাগীদার তিনি। ২০১০ সালে বিশ্ববিখ্যাত তেল কোম্পানি শেভরনের সঙ্গে বাংলাদেশের গ্যাস-সংক্রান্ত একটি মামলায়ও আন্তর্জাতিক আদালতে বাংলাদেশকে বিজয়ী করেন তিনি। জাতিসংঘের প্রতিনিধি স্পেশাল রেপোর্টিয়ার হিসেবে ১৯৯৮ সালে ৫ বছর কাজ করেছেন আফগানিস্তান। পাশাপাশি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক কর্মকা-ে সক্রিয় রয়েছেন তিনি। মানবাধিকার নিয়েও উচ্চকিত ড. কামাল হোসেন। পড়াশোনা শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, লন্ডনের অক্সফোর্ডের অলসোলস কলেজ, নাফিল কলেজে শিক্ষকতা করেছেন তিনি। বৃটিশ বারের সদস্য হিসেবে তালিকাভুক্ত কামাল হোসেন কাজ করেছেন বহুজাতিক ল’ ফার্ম অরডিগনামে। বাংলাদেশের হাইকোর্টে আইন পেশায় প্র্যাকটিস শুরু করেন ১৯৫৯ সালের ১৬ই জুন। দীর্ঘ প্রায় ৬ দশকের আইন উজ্জ্বল পেশা তার।
ড. কামাল হোসেনের পিতা ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে ইলেকট্রোথেরাপি বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা ডা. আহমদ হোসেন ও মা হোসনে আরা বেগম। তার পৈতৃক নিবাস বরিশালের শায়েস্তাবাদের ঐতিহ্যবাহী জমিদারবাড়ি। ১৯৫১ সালে সেন্ট গ্রেগরি থেকে ম্যাট্রিক, ১৯৫৩ সালে সেন্ট গ্রেগরি থেকে প্রথম স্থান অধিকার করে আইএ পাসের পর শিক্ষা বৃত্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যান তিনি। ইন্ডিয়ানার নটর ডেম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁর দ্যুতিময় একাডেমিক রেকর্ড দেখে তাকে সরাসরি থার্ড ইয়ারে ভর্তির সুযোগ করে দিয়েছিল। ইন্ডিয়ানার নটর ডেম থেকে অর্থনীতিতে অনার্স পাসের পর ১৯৫৭ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জুরিসপ্রুডেন্সে স্নাতক (সম্মান) ও ১৯৫৮ সালে ব্যাচেলর অব সিভিল ল ডিগ্রি অর্জন করেন। লিংকনস ইনে বার-অ্যাট-ল অর্জনের পর ১৯৬৪ সালে পিএইচডি করেন আন্তর্জাতিক আইনে। অক্সফোর্ডে তাঁর সুপারভাইজার স্যার হামফ্রি ওয়াল্ডক হেগের ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। অক্সফোর্ড মজলিশ সোসাইটির সভাপতি হিসেবে ১৯৫৬ সালে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন সুয়েজ যুদ্ধের প্রতিবাদে আয়োজিত ছাত্র ধর্মঘটে।
তার সহধর্মিণী ড. হামিদা হোসেন একজন নারী নেত্রী ও মানবাধিকারকর্মী। পাকিস্তানের এক বিচারকের কন্যা সিন্ধু প্রদেশের এ নারী ঢাকায় বোনের বাড়িতে বেড়াতে এসে নিউ ভ্যালুজ ক্লাবের সূত্রে পরিচয় ঘটেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. কামালের সঙ্গে যার পরিণতি পায় ১৯৬৪ সালে লন্ডনে। সত্তরের দশকে অক্সফোর্ডের সেন্ট অ্যান্টোনিস কলেজ থেকে ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে বাংলার বস্ত্রশিল্পের উৎপাদন’ বিষয়ের ওপর পিএইচডি করেন তিনি। যিনি বয়সে ছিলেন একবছরের সিনিয়র। ব্যক্তিজীবনে দুই কন্যার জনক ড. কামাল হোসেন। তার বড় মেয়ে সারা হোসেন দেশের একজন বিশিষ্ট আইনজীবী। জামাতা ডেভিড বার্গম্যান বৃটিশ বংশোদ্ভূত একজন খ্যাতিমান সাংবাদিক। যিনি একাত্তরের ঘাতকদের ওপর বিবিসি চ্যানেল ফোরের ডকুমেন্টারির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। দুজনে বসবাস করেন বাংলাদেশে। ছোট মেয়ে দিনা হোসেন একজন চিত্রপরিচালক। তার স্বামী আইরিশ বংশোদ্ভূত গ্রাহামও একজন চিত্রপরিচালক। নাইন-ইলেভেনের পর মুসলমানদের ওপর একটি ইতিবাচক ডকুমেন্টারি নির্মাণ করতে গিয়ে দুজনের পরিচয়ের পর বিয়ে। তারা দুজন নিউ ইয়র্কে বসবাস করেন। ৮০ বছর বয়সী এই জীবন্ত কিংবদন্তির পুরো জীবনটাই বর্ণিল ও কর্মময়।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর