উচ্চশিক্ষায় প্রবীণ বিষয়টি যেভাবে আছে

পুঁথিগত বিদ্যা এবং হাতেকলমে প্রবীণের সেবাযত্নের প্রশিক্ষণ আগামী দিনের প্রবীণবান্ধব নার্স পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের দেশের উচ্চশিক্ষায় প্রবীণ বিষয়টি যেভাবে আছে, তার আরও সম্প্রসারণ করা সম্ভব। পরিকল্পিতভাবে সম্প্রসারণ না করলে শুধু সিলেবাসসর্বস্ব উচ্চশিক্ষা হবে, যা সনদের মধ্যে আটকে থাকবে
প্রবীণ বিষয়ে যারা কাজ করেন তাদের বলতে শুনি, শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রবীণ বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়া হয়নি। আবার সাধারণ মানুষকে বলতে শুনি, লেখাপড়ায় প্রবীণদের কথা নেই। কথা বলে দেখেছি, আমাদের শিক্ষাসংশ্লিষ্ট পণ্ডিত ব্যক্তিরা প্রবীণ বিষয়ে খণ্ডিত ধারণা রাখেন। উচ্চশিক্ষায় প্রবীণ বিষয়টি কীভাবে আছে, তা জানতে আমি তথ্য সংগ্রহ করলাম। পাঠকের কাছে বিষয়টি সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনায় তুলে ধরব। প্রথমেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবীণবিষয়ক পড়াশোনা। কলা ভবনে সমাজবিজ্ঞান বিভাগে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ‘জরাবিজ্ঞান’ কোর্সটি পড়ানো হয়। সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে চার ভাগের একভাগ ছাত্রছাত্রীকে ১০০ নম্বরের ‘জরাবিজ্ঞান’ কোর্সটি পড়ানো হয়। বছর পাঁচেক আগে সমাজকল্যাণ গবেষণা ইনস্টিটিউট এক বছরের মাস্টার্স ডিগ্রি চালু করে। দুই সেমিস্টারে মোট ৪৪ ক্রেডিট এবং ১১০০ নম্বরের পরীক্ষা। সিলেবাসে জরাবিজ্ঞান সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভের জন্য পর্যায়ক্রমে সাজানো হয়েছে।
বার্ধক্য কী? বার্ধক্যের চ্যালেঞ্জগুলো কী? বিশ্বে প্রবীণ জনসংখ্যা বৃদ্ধি। বাংলাদেশে বার্ধক্য পরিস্থিতি। বার্ধক্যে সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগ। বার্ধক্যে মানবাধিকার এবং জাতিসংঘের ভূমিকা। বার্ধক্যকে স্বস্তিদায়ক এবং শান্তিপূর্ণ করা। বার্ধক্যে ওষুধপথ্য, সেবাযত্ন, খাবারদাবার।
উপর-উক্ত বিষয়ে ছাত্রছাত্রীদের পরিষ্কার ধারণা দেয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এ ডিগ্রি গ্রহণ করার পর কোথায়-কীভাবে কাজ করবেন, তার দিকনির্দেশনা নেই। প্রায় ৪০০ ছাত্রছাত্রী এরই মধ্যে ডিগ্রি অর্জন করেছেন এবং ভবিষ্যতে আরও অনেকেই ডিগ্রি পাবেন। তারা কোথায়-কীভাবে কাজ করবেন, তা সুনির্দিষ্ট করা জরুরি। সরকারের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের আলোচনা অব্যাহত রাখতে হবে। গুরুত্বপূর্ণ বার্ধক্য ইস্যুটি শিক্ষা ব্যবস্থায় এবং কর্মক্ষেত্রে যথাযথ ভূমিকা রাখতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ খুবই জরুরি ব্যাপার। বার্ধক্য ইস্যুটি আমাদের দেশের জন্য মারাত্মক একটি ইস্যু হিসেবে উপস্থিত হয়েছে। আগামী দিনের প্রবীণ জনগোষ্ঠী বিশ্ব অর্থনীতির জন্য বড় ধরনের হুমকি বলে আগাম সতর্কতা দেয়া হয়েছে। বার্ধক্য বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি লাভের পর সেটি অবশ্যই বাস্তবে প্রয়োগের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায় বার্ধক্যের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা দুরূহ হয়ে পড়বে। দেশের অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবীণ বিষয়টি কীভাবে নেয়া হয়েছে, তা আমার জানা নেই। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় প্রবীণ বিষয়টি দুই-একটি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া অন্যরা তেমন গুরুত্ব দেয়নি। ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রবীণ বিষয়টিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘আর্ট অব লিভিং’ নামে একটি কোর্স পড়ানো হয়। এতে বার্ধক্য বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া সব ছাত্রছাত্রীকে বাধ্যতামূলক ‘আর্ট অব লিভিং’ পড়ানো হয়। এতে সব বিভাগের ছাত্রছাত্রীরা প্রবীণ বিষয়ে পরিষ্কার একটি ধারণা লাভ করেন। ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা সামাজিক অনুষ্ঠানে মা-বাবার ভরণপোষণ, সেবাযত্ন করবেন বলে শপথ করেন।
বছরের একটি দিনে বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাম্পাসে ছাত্রছাত্রীরা মা-বাবার পা নিজের হাতে ধুয়ে দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘জরাবিজ্ঞান’ বিভাগের ছাত্রছাত্রীরা প্রবীণ বিষয়ে বিভিন্ন গবেষণামূলক কাজে অংশগ্রহণ করেন এবং সভা, সেমিনার, মানববন্ধন, র‌্যালি, দিবস পালন করে থাকেন। দেশের মেডিকেল কলেজ এবং মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে বার্ধক্য বিষয়ে আলাদা কোনো কোর্স পড়ানো হয় না বলে জানি। মেডিকেল শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা হলে তারা বলেন, আমরা মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত পড়াই। বার্ধক্যকে বিলম্বিত করা যায়, কিন্তু ঠেকানো যায় না। বার্ধক্যের চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে মেডিকেল শিক্ষার্থীরা জানেন। আমি বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের কাছে জানতে চেয়েছি, দেশে শিশুবিশেষজ্ঞ রয়েছেন কিন্তু বার্ধক্য বিশেষজ্ঞ নেই। এ প্রশ্নের উত্তরে অনেকেই হেসেছেন। তারা আমাকে বলেছেন, বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের চেম্বারে অপেক্ষাকৃত প্রবীণরাই বেশি আসেন। বার্ধক্য বিশেষজ্ঞ একজন প্রবীণের সব স্বাস্থ্য সমস্যার সমাধান দিতে পারবেন না। আলাদা প্রত্যেকটা শারীরিক সমস্যার জন্য আলাদা আলাদা বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে। প্রবীণদের শারীরিক, মানসিক চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা অবহিত রয়েছেন। প্রবীণদের সুচিকিৎসা এবং বিশেষ সেবাযত্ন করার জন্য হাসপাতালগুলোতে ‘জেরিয়েট্রিক ওয়ার্ড’ খোলার কাজ শুরু হয়েছে। কয়েকটি হাসপাতালে জেরিয়েট্রিক ওয়ার্ড খোলা হয়েছে। বার্ধক্য চিকিৎসাসেবা গুরুত্বপূর্ণ। তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো যথাযথ সেবাযত্ন পাওয়া। এক্ষেত্রে জেরিয়েট্রিক নার্সিং বা প্রবীণ সেবা প্রধান বিষয় হিসেবে আমাদের সামনে হাজির হয়েছে। সরকার নার্সিং শিক্ষায় বাধ্যতামূলক ১০০ নম্বরে জেরিয়েট্রিক নার্সিং যুক্ত করেছে। এ কোর্সটি ক্লাসে পড়ানো হবে ৬৪ ঘণ্টা এবং ব্যবহারিক ক্লাস হবে ৯৬ ঘণ্টা। জেরিয়েট্রিক নার্সিং কোর্সটিতে উন্নত বিশ্বের প্রচলিত মান বজায় রাখা হয়েছে।
এ কোর্সটিকে ছয় ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। প্রথম ভাগে বাংলাদেশের প্রবীণ জনসংখ্যা, সম্ভাব্য আয়ুষ্কাল, অসুস্থতা, মৃত্যু, স্বাস্থ্যনীতিতে প্রবীণ সেবা, বার্ধক্যের তত্ত্ব, বার্ধক্যের সাধারণ পরিবর্তন ইত্যাদি। দ্বিতীয় ভাগে প্রবীণদের স্বাস্থ্যসেবা, প্রবীণদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি, সমন্বিত স্বাস্থ্যসেবা ইত্যাদি। তৃতীয় ভাগে বাংলাদেশের প্রবীণদের সাধারণ স্বাস্থ্য সমস্যাগুলো। চতুর্থ ভাগে স্বাস্থ্য উন্নয়ন এবং রোগপ্রতিরোধ, কাজকর্ম ও ব্যায়াম, পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ এবং বিপজ্জনক খাবার বর্জন, ঘুম ও বিশ্রাম, ওষুধ গ্রহণে সতর্কতা, মানসিক প্রশান্তি বজায় রাখা। পঞ্চম ভাগে পড়ে গিয়ে ব্যথা পাওয়া কিংবা ভেঙে যাওয়া, চলাচল করা ক্ষমতা হ্রাস পাওয়া, ব্যথা-বেদনা, পায়খানা-প্রস্রাব আটকাতে না পারা, হৃদরোগ, থায়রেডের সমস্যা, শারীরিক অনুভূতির সমস্যা। ষষ্ঠ ভাগে রয়েছে দুরারোগ্য ব্যাধির সঙ্গে বসবাস, মৃত্যু চিন্তা এবং প্রিয়জনের মৃত্যু ও প্রবীণ নির্যাতন। প্রশিক্ষণ গ্রহণকারী একজন নার্স প্রবীণের শারীরিক ও মানসিক সমস্যা সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা লাভ করবেন। একজন প্রশিক্ষিত নার্স হাসপাতাল কিংবা ক্লিনিকে অসুস্থ প্রবীণকে যথাযথ সেবা প্রদান করতে পারবেন। বাংলাদেশে বর্তমানে সাতটি মেডিকেল কলেজে এবং বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪ বছর মেয়াদি বিএসসি (নার্সিং) কোর্স চালু হয়েছে। প্রতি ব্যাচে ১০০ জন ভর্তি হতে পারেন। আটটি প্রতিষ্ঠানে বিএসসিতে (নার্সিং) মোট ৮০০ জন ভর্তি হতে পারেন। মেডিকেল কলেজগুলো হলো ঢাকা, ময়মনসিংহ, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, রংপুর, বরিশাল ও সিলেট। ডিপ্লোমা নার্সিং পাস করা ছাত্রছাত্রীরা মহাখালী, বগুড়া, খুলনা, ফৌজদারহাট বিএসসি নার্সিং কলেজে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান। প্রতিটি কলেজে ১২৫ জন করে মোট ৫০০ জন ভর্তি হতে পারেন। সরকারি ৩৭টি নার্সিং ইনস্টিটিউটে প্রতি বছর ভর্তি হন ২ হাজার ২৮০ জন ছাত্রছাত্রী। বেসরকারি নার্সিং ইনস্টিটিউট রয়েছে ৪৭টি। এতে কতজন ভর্তি হন, তা বলা কিছুটা মুশকিল। কমপক্ষে ২ হাজার ছাত্রছাত্রী ভর্তি হন বলে প্রাথমিক অনুসন্ধানে জানা গেছে। দেশের নামকরা কয়েকটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজে বিএসসি (নার্সিং) পড়ার সুযোগ রয়েছে। সেখানে ৩৫০ থেকে ৪০০ জন ছাত্রছাত্রী পড়াশোনা করছেন। প্রতি বছর প্রায় ৬ হাজার ছাত্রছাত্রী নার্সিং প্রশিক্ষণের মাধ্যমে জেরিয়েট্রিক নার্সিং শেখেন। পুঁথিগত বিদ্যা এবং হাতেকলমে প্রবীণের সেবাযত্নের প্রশিক্ষণ আগামী দিনের প্রবীণবান্ধব নার্স পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের দেশের উচ্চশিক্ষায় প্রবীণ বিষয়টি যেভাবে আছে, তার আরও সম্প্রসারণ করা সম্ভব। পরিকল্পিতভাবে সম্প্রসারণ না করলে শুধু সিলেবাসসর্বস্ব উচ্চশিক্ষা হবে, যা সনদের মধ্যে আটকে থাকবে।

লেখক : সভাপতি, এজিং সাপোর্ট ফোরাম
ট্রেজারার, বাংলাদেশ জেরোন্টলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএ)

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর