আমাদের মুক্তিসংগ্রাম ও আন্তর্জাতিক সমর্থন : শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ

ডিসেম্বর মাস আমাদের জাতির বিজয়ের মাস। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী, সামরিক বাহিনী এবং তাদের সহযোগীরা পরাজয় স্বীকার করে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। বিশ্বের বুকে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ-স্বাধীনতা-বাংলাদেশের অভ্যুদয়। এই গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের মহানায়ক হচ্ছেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

আমাদের ‘মুক্তিযুদ্ধ-স্বাধীনতা-বাংলাদেশ-বঙ্গবন্ধু’ এই শব্দগুলো অবিচ্ছেদ্য। এগুলোকে সমার্থকও বলা যেতে পারে। আমাদের জনগণের দীর্ঘ সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের ঘোষণা প্রদান করেন। আমাদের বীর জনগণ সর্বশক্তি নিয়ে আক্রমণকারী সশস্ত্র পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ৩০ লাখ মানুষ জীবন দিয়েছে। এক কোটি মানুষ দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছে। কোটি কোটি মানুষ নানাভাবে নির্যাতিত, নিপীড়িত, ক্ষতিগ্রস্ত, লুণ্ঠিত, অত্যাচারিত হয়েছে। মা-বোনের ইজ্জত-সম্ভ্রম সব হারিয়ে লড়াই চালিয়ে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় পতাকা উড়িয়ে মাতৃভূমিকে স্বাধীন করেছে।

পাকিস্তানি শাসক শ্রেণির বিরুদ্ধে শোষণ-বঞ্চনা-বৈষম্যের অবসান, গণতন্ত্র, স্বায়ত্তশাসন, জাতীয় অধিকার, শিক্ষার জন্য সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের পক্ষে জনগণের অভূতপূর্ব রায় প্রদান এক নতুন পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। সে রায় অনুসারে বঙ্গবন্ধুর হাতে ক্ষমতা দিয়ে আওয়ামী লীগকে সরকার গঠন করতে না দিয়ে পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া-ভুট্টো মিলে নানা ষড়যন্ত্র শুরু করেন। নির্বাচিত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ৩ মার্চ আহ্বান করলেও ১ মার্চ তা স্থগিত করে দেন। তাৎক্ষণিক বাংলাদেশের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাজপথে নেমে আসে স্বাধীনতার স্লোগান নিয়ে। বঙ্গবন্ধু তাৎক্ষণিক পূর্বাণী হোটেলে আওয়ামী লীগের নির্বাহী কমিটির চলমান সভা শেষে সংবাদ সম্মেলন করে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করেন। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু যেসব দিকনির্দেশনা ও কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন, সে অনুসারে ২৫ মার্চ পর্যন্ত দেশব্যাপী চলে চূড়ান্ত প্রস্তুতি।

ষাটের দশকে সামরিক শাসনবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলন, শিক্ষানীতির জন্য সংগ্রাম, সর্বোপরি বঙ্গবন্ধু উত্থাপিত ৬ দফার সংগ্রাম এবং ‘৬৯-এ সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফার (যার মধ্যে ৬ দফা দাবি অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং ১ নম্বর দাবি ছিল শিক্ষার দাবি) ভিত্তিতে ‘৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা (যার মূল উদ্দেশ্য ছিল বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা) প্রত্যাহারের ফলে বঙ্গবন্ধু মুক্তিলাভ করেন। বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে জাগ্রত করেন, সচেতন করেন। ঐক্যবদ্ধ ও সংগঠিত করে নেতৃত্ব দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করতে সক্ষম হন।

একাত্তরের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মহাসমাবেশে তৎকালীন জটিল পরিস্থিতি বিশ্লেষণ, নতুন করণীয় নির্ধারণ, স্বাধীনতার প্রস্তুতি ও সংগ্রামের নির্দেশনা দেন। ইতিহাসের এই অতুলনীয় ভাষণে তিনি ঘোষণা দেন :’এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এটাই ছিল স্বাধীনতার প্রকৃত ঘোষণা। ২৬ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনী গণহত্যা শুরু করলে বঙ্গবন্ধু আনুষ্ঠানিকভাবে এবং জাতীয় পরিষদের নির্বাচিত অধিকাংশ সদস্যের নেতা (প্রধানমন্ত্রী, যা সামরিক শাসকরা হতে দেয়নি) হিসেবে বৈধভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। জনগণের রায়ের ফলে যা আনুষ্ঠানিকভাবে বৈধতা লাভ করেছিল। ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর ঐক্যবদ্ধ মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করে বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলাম।

২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে বন্দি করে রাখে। তাকে তারা হত্যার চেষ্টা করেও আন্তর্জাতিক চাপের কারণে তা করতে সক্ষম হয়নি। বঙ্গবন্ধু বন্দি থাকায় আমাদের স্বাধীনতা ও বিজয় ছিল অসম্পূর্ণ। শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানি শাসকরা তাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় এবং তিনি ১০ জানুয়ারি দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে নস্যাৎ করে পরাধীন করে রাখার জন্য পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী এবং তাদের আন্তর্জাতিক সহযোগী শক্তির সমর্থনে ও বিশেষ করে বাংলাদেশের একটি বিশেষ মহল সব ধরনের হত্যা, লুট, নির্যাতন, অগি্নসংযোগ, মা-বোনের ইজ্জত লুটে নেওয়ার সঙ্গে সর্বাধিক সক্রিয় ছিল। এদের মধ্যে প্রধান শক্তি ছিল জামায়াতে ইসলামী ও তার সহযোগী ইসলামী ছাত্রশিবির (তখন নাম ছিল ইসলামী ছাত্রসংঘ) এবং মুসলিম লীগের অধিকাংশ নেতাকর্মীসহ সাম্প্রদায়িক, স্বাধীনতাবিরোধী কিছু শক্তি। মুক্তিযুদ্ধের শেষদিকে পরাজয় নিশ্চিত জেনে বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করার লক্ষ্যে স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবির পরিকল্পিতভাবে আমাদের বুদ্ধিজীবী শিক্ষক ও সব ধরনের মেধাবীদের হত্যা করেছিল। এসব অপরাধীর অনেকের বিচার হয়েছে এবং মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এখনও চলছে।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিশ্বব্যাপী বিরাট প্রভাব সৃষ্টি করেছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রত্যক্ষভাবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে পরাজিত করার জন্য সব ধরনের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছিল। দুর্ভাগ্যক্রমে গণচীনও পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করেছিল।

প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের সব ধরনের সমর্থন ও সহযোগিতা ছিল আমাদের জন্য সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ শক্তি। তারা এক কোটি মানুষকে আশ্রয় ও সেবা দিয়েছিল। ভারত সরকার আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ, সমর্থন ও সাহায্য করেছিল। বিশ্বজনমত গড়ে তুলতে সম্ভব সবকিছুই করেছিল। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধভাবে সব সাধারণ মানুষ, কংগ্রেস পার্টি, সিপিআইসহ প্রায় সব রাজনৈতিক দল বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ভারতের সেনাবাহিনীর অনেক সদস্য আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে থেকে লড়াই করে শহীদ হয়েছেন।

আন্তর্জাতিকভাবে আরেকটি বড় উপাদান ছিল তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকার বিরুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়ন অবস্থান নিয়ে সরাসরি আমাদের স্বাধীনতার পক্ষে সমর্থন ও সাহায্য না করলে পরিস্থিতি আরও জটিল, দীর্ঘসূত্রী ও বিপজ্জনক হতে পারত। ১৯৭১-এর ২৯ মার্চ সোভিয়েত ইউনিয়নের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগর্নি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টকে একটি পত্র লিখে গণহত্যা বন্ধ করতে এবং শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনের নিরাপত্তা বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। চিঠিতে তিনি বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে লিখেছিলেন। জাতিসংঘে পাকিস্তান ও আমেরিকার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে ভেটো প্রদান, বঙ্গোপসাগরে পাঠানো মার্কিন সপ্তম নৌবহর ফিরিয়ে নেওয়া ইত্যাদি বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পথ সুগম করেছিল।

আমরা আন্তর্জাতিক জনমত, ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী এবং ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকার জন্য তাদের কাছে কৃতজ্ঞ ও ঋণী। বিপদের সময়ের বন্ধুদের আমরা ভুলে যেতে পারি না।

আমি ব্যক্তিগতভাবে ষাটের দশকের শুরু থেকে ছাত্র আন্দোলনের একজন কর্মী হিসেবে সব সংগ্রামে সরাসরি সম্পৃক্ত থাকার ফলে একজন সংগঠক ও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে লড়াই করার সুযোগ পেয়েছিলাম। তৎকালীন অন্যতম বৃহৎ ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি হিসেবে পৃথক গেরিলা বাহিনী গঠন করার জন্য ভারত সরকারের সব সাহায্য আদায় ও কাজে লাগানোর সুযোগ পেয়েছিলাম। আমি শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী, ডিপি ধর, পিএন হাকসার যারা ভারতের পক্ষে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে দায়িত্বে ছিলেন, আমাকে সন্তানতুল্য স্নেহ ও সাহায্য করেছিলেন।

‘৭১-এর ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে স্লোভাকিয়ার রাজধানী ব্রাতিস্লাভায় (তখন চেক্ ও স্লোভাকিয়া এক রাষ্ট্র ছিল) আন্তর্জাতিক ছাত্র ইউনিয়নের (International Union of Students-IUS) দশম আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আমন্ত্রণ পেয়ে যোগদান করতে গিয়েছিলাম। এর আগে অনুমতি না পাওয়ার কারণে পাকিস্তান থেকে কোনো ছাত্রনেতা আন্তর্জাতিক কোনো ছাত্র সম্মেলনে যোগদান করার সুযোগ পাননি। আন্দোলনের চাপের মুখে পাকিস্তান সরকার শেষ মুহূর্তে আমাকে এক মাসের জন্য পাসপোর্ট দিতে বাধ্য হয় (কেবল চেকোস্লাভিয়া যাওয়ার জন্য)। এ সুযোগ গ্রহণ করে গোপনে আমি যাতায়াতের পথে ৯ দিন মস্কোতে থেকে বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা করার সুযোগ গ্রহণ করি। এ ঘটনা তখন কেবল বঙ্গবন্ধু এবং সিপিবি নেতা কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ জানতেন। সেভাবে তারা ব্যবস্থা করেছিলেন। এ দু’জনের বাইরে আর কেউ জানতেন কি-না তা আমি জানি না বা কখনও জানতে চাইনি। আমি তখন বয়স ও অভিজ্ঞতায় অনেক ছোট। কিন্তু সোভিয়েতের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা আমার আবেগ ও বাস্তব অবস্থার বর্ণনা, জনগণের মতামত, দৃঢ়তা, বিভিন্ন সংগ্রামে তাদের অবস্থান, অতীতের বিভিন্ন ঘটনা ছাত্র-তরুণদের মতামত বোঝা ও জানার চেষ্টা করেছিলেন। এক কথায়, প্রত্যক্ষভাবে সংগ্রামের একজন তরুণ কর্মীর কাছ থেকে যথাসম্ভব তারা বোঝার চেষ্টা করেন সাফল্যের সম্ভাবনার দিকগুলো। আমি মরিয়া হয়ে আমার আবেগ ও বাস্তবতা দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেছি- পাকিস্তানিদের স্বৈরাচারী শাসন-শোষণ-নিপীড়নে পিষ্ট বাঙালিরা অদম্য সাহস, মনোবলসহ সর্বশক্তি নিয়ে তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে, মরণপণ যুদ্ধ করছে। এ সংগ্রাম অবধারিত এবং আমরা জিতবই। পাকিস্তানিদের যুদ্ধ পরিচালনা করতে হবে এক হাজার মাইল দূর থেকে; মাঝখানে রয়েছে আমাদের বড় বন্ধু ভারত। পাকিস্তানিরা ব্যর্থ হতে বাধ্য। আমেরিকা ও দুনিয়ার স্বাধীনতা বিরোধীদের তোমরা সামলাবে।

ব্রাতিস্লাভায় আন্তর্জাতিক ছাত্র ইউনিয়নের (isu) সম্মেলনে আমি খুবই সক্রিয় ভূমিকা পালন করি। ভারত, সোভিয়েতসহ বিভিন্ন দেশের ছাত্রনেতারা আমাকে খুবই সাহায্য-সমর্থন দেন। ফলে নির্বাহী কমিটিতে আমি নির্বাচিত হই। আমাদের পক্ষ সমর্থন করে প্রস্তাব গ্রহণ, সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে যোগাযোগ এবং মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন দুনিয়ার সব দেশের ছাত্র-যুব সংগঠনের কাছে ১ মে, ১৯৭১ আমার চিঠি (সূত্র :১০ মে, ১৯৭১, লেখা আমার চিঠি ১৫ খণ্ডে প্রকাশিত স্বাধীনতা যুদ্ধ ও দলিলপত্র) আমাদের পক্ষে যে ইতিবাচক সমর্থন ও সাহায্য লাভে সহায়ক হয়েছিল, তা পরবর্তীকালে সোভিয়েত ইউনিয়নের অনেক নেতাই আমাকে বলেছেন। পরে ওই সময়ের ছাত্র-যুবনেতা অনেকের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়। তারা আমাকে বলতেন- তুমি কী করে গেছো, তা তুমি নিজেও বোঝনি। এ বিষয়টি আমি পূর্বে কখনও লিখিনি বা বলিনি, যদিও অনেকেই জানেন। সম্মেলনে যোগদানের বিষয়টি পত্রিকায়ও তখন ছাপা হয়েছে। কিন্তু মস্কোতে থাকার বিষয়টি গোপন ছিল।

আজ অনেক ঘাত-প্রতিঘাত, উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, লক্ষ্য ও আদর্শের পথে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ‘সোনার বাংলা’ প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। ২০২১ সালের মধ্যে ‘মধ্যম আয়ের রাষ্ট্র’ এবং ডিজিটাল বাংলাদেশের লক্ষ্য অর্জন করার অগ্রগতি দৃশ্যমান। ২০৪১ সালের মধ্যে আমরা একটি দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত রাষ্ট্রের পর্যায়ে উন্নীত হতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এ জন্য আমাদের নতুন প্রজন্মকে প্রস্তুত করার সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কাজ করে যাচ্ছে। আমাদের মূল লক্ষ্য- নতুন প্রজন্মকে আধুনিক উন্নত বাংলাদেশের নির্মাতা হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি। সেই লক্ষ্যে প্রণীত জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।

শিক্ষাক্ষেত্রে এখন আমাদের প্রধান চ্যালেঞ্জ, নতুন প্রজন্মের জন্য বর্তমান যুগের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ, গুণগত মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা। এ জন্য সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়- শিক্ষক। সমগ্র জাতিকে তা উপলব্ধি করে শিক্ষকদের সম্মান-মর্যাদা, সহযোগিতা ও সমর্থন দিতে হবে। শিক্ষকদেরও ‘নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক’ হিসেবে প্রকৃত শিক্ষাদান, ভালোমানুষ হিসেবে শিক্ষার্থীদের গড়ে তোলার কাজে অবদান রাখতে হবে। শিক্ষার্থীদের সততা, নিষ্ঠা, দায়িত্বশীলতা, জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা ও শ্রদ্ধাবোধ, নৈতিক মূল্যবোধ, দেশপ্রেমে উজ্জীবিত করে পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।

তাই শিক্ষকদের পাঠদান, শিক্ষার্থীর চরিত্র গঠন, পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার কাজ ও দায়িত্বকে আন্তরিকভাবে গ্রহণ করতে হবে। সততার সঙ্গে মহান দায়িত্ব পালন করতে হবে। না হলে আমাদের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হতে বাধ্য। তাই শিক্ষকদের জীবনাচরণ ও সার্বিক দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে মৌলিক পরিবর্তন আনতে হবে। নৈতিক মূল্যবোধ আমাদের সমাজে বিরাট অবক্ষয়ের দীর্ঘদিনের ধারাবাহিকতা থেকে সর্বাগ্রে শিক্ষকদের বেরিয়ে এসে শিক্ষার মূল লক্ষ্য অর্জনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।

আমরা আশা করি, আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষকরা তার দায়িত্ব পালনে আরও বেশি সচেতন হবেন এবং আমাদের লক্ষ্য অর্জনে তাদের ভূমিকা রাখবেন; আমাদের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, লক্ষ্য ও আদর্শ এবং সব শহীদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে উপযুুক্ত ভূমিকা পালন করে জাতির ইতিহাসে নিজের মর্যাদার আসন স্মরণীয় করে রাখবেন।

আমাদের নতুন প্রজন্মকে বর্তমান যুগের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ বিশ্বমানের শিক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রযুক্তিতে দক্ষ এবং সততা, নিষ্ঠা, জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ ও শ্রদ্ধাশীল, নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন, দেশপ্রেমে উজ্জীবিত পরিপূর্ণ মানুষ তৈরি করার মহান কর্মযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছি। এ পথেই আমাদের দেশকে মর্যাদাশীল রাষ্ট্রে পরিণত করতে আমাদের সফল হতে হবে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ও আদর্শ এবং শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সমগ্র জাতি সেই ধারাবাহিকতায় এগিয়ে যেতে সক্ষম হবে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিজয় সার্থক হবে।

শিক্ষামন্ত্রী, বাংলাদেশ সরকার

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর