অন্ধকারে জোনাকী মৃত্যুর পরে কেন বাড়ি ফিরতে চায় মানুষ

মনিজা রহমান: সুনামগঞ্জের ছাতকে কাইষ্টোকোনা গ্রামে কবরে ঘুমিয়ে আছেন ইসাদ আলী!
ইসাদ আলীকে চেনেন তো? তিনি ছিলেন একজন দুঃসাহসী নাবিক। একজন শিপ জাম্পার। চলন্ত জাহাজ থেকে কূল নাই, কিনারা নাই জেনেও অসম্ভব দুঃসাহসের এক কাজ করেন। ঝাঁপিয়ে পড়েন অকূল সমুদ্রের বরফ শীতল জলে। মুমূর্ষু অবস্থা থেকে কেবল ভাগ্যজোরে বেঁচে যান ইসাদ আলী। এক সময় তিনি হন জীবন সংগ্রামে বিজয়ী বীর। ‘বোম্বে ইন্ডিয়া’ নামে দুটি রেস্টুরেন্ট চালু করেন ম্যানহ্যাটানে। বাংলাদেশিদের মধ্যে প্রথম ও উপমহাদেশের মধ্যে দ্বিতীয় ব্যক্তি তিনি, যিনি ম্যানহাটানে রেস্টুরেন্ট স্থাপন করেছিলেন। স্বপ্নের দেশ আমেরিকায় বাঙালি অভিবাসীদের অগ্রবর্তীদের একজন তিনি।
সারাজীবনের লড়াই-সংগ্রাম, তারপর সাফল্যের চূড়ায় আরোহণ, কিন্তু এক মুহূর্তের জন্য তিনি ভুলতে পারেননি কাইষ্টোকোনা গ্রামকে। ১৯৪৭ সালের কোন এক সময়ে জাহাজ থেকে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়া সেই ইসাদ আলীকে তার শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী দাফন করা হয় নিজ গ্রামের মাটিতে।
কেন মানুষ বাড়ি ফিরতে চায়? জীবনে না হোক, অন্তত মৃত্যুর পরে হলেও জন্মভূমিতে ফিরতে চাই মানুষ! শিকড়ে ফেরার এই যে বাসনা, কেন? কিছুদিন ধরে এই ভাবনা আমাকে খুব তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে।
কবি শহীদ কাদরী ও সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের মৃত্যুর পরে ভাবনাটা তীব্র হয়েছে। বাড়ি ফেরার আকুল বাসনা যেন মানুষের রক্তে মিশে থাকে। তাকে দিনরাত তাড়া করে ফেরে এই চিন্তা। ‘বাড়ি ফিরবো’ ‘বাড়ি ফিরবো’ বলে আত্মচিৎকার ঝরে কবিতায়।
জীবনানন্দ দাসের কবিতার পঙক্তির মতো- সব পাখি ঘরে আসে, সব নদী ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন। ফুরিয়ে যাবার পরেও মনের বাসনা ফুরায় না। মৃত্যুর আগে শেষ ইচ্ছা জানিয়ে যায় তারা, অন্তিম ঠিকানা যেন নিজের গ্রামে, বা নিজের শৈশব-কৈশোরের শহরে হয়! গেল সেপ্টেম্বরে পরপারে পাড়ি দেয়া দুই কবির শেষ আকাঙ্ক্ষাতেও ছিল তারই অনুরণন। শিকড়ে ফিরতে চেয়েছিলেন তারা। তাদের শেষ ইচ্ছা পূরণ করেছে স্বজনেরা।
কবি শহীদ কাদরী নিউইয়র্ক থেকে ফিরে গেছেন কৈশোর আর তারুণ্যের স্মৃতিবিজড়িত শহর ঢাকায়। অথচ বহুকাল তিনি ছিলেন দেশছাড়া। বাউণ্ডুলের মতো ঘুরে বেড়িয়েছেন সারা পৃথিবী। এই এলোমেলো জীবনে দুটি জিনিষ তিনি কখনও হাতছাড়া করেননি। একটা কবিতা, অন্যটি সবুজ পাসপোর্ট। নিউইয়র্কে বসবাসরত কবি শহীদ কাদরীর স্ত্রী নীরা কাদরী বলেছেন, ‘শহীদ সব সময়ই চেয়েছে বাংলাদেশে ফিরতে। কিন্তু অসুস্থতার কারণে সম্ভব হচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত ঠিকই ফিরল ও।’
ভাবলে অবাক লাগে, শহীদ কাদরীর মতো একজন মানুষ যিনি ১৯৭৮ সাল থেকে ঘরছাড়া, কেন এত বছর ধরে বাংলাদেশের সবুজ পাসপোর্ট ধরে রেখেছিলেন। ওনার মৃত্যুর পরে সেটাই ছিল বড় প্রশ্ন। উনি তো চাইলে আমেরিকার নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারতেন! যে কোনো মানুষের সাধারণত প্রবৃত্তি তো তাই। কিন্তু কবি তার বাঙালি পরিচয়কে দ্বিতীয় স্তরে নামিয়ে আনেননি। বাংলা ভাষার কবি হিসেবে তিনি পারেননি এটা করতে! এ যেন জন্মের ধার শোধ।
কবিকে খুব কাছ থেকে চিনতেন সংগীতশিল্পী, গীতিকার, অভিনেতা, চিত্রশিল্পী তাজুল ইমাম। বহুপ্রতিভাধর এই মানুষটিকে নিউইয়র্ককে সবাই ডাকে ‘তাজু ভাই’ বলে। কেন এই শিকড়ে ফেরা? তাজুল ইমাম বললেন, ‘দেখুন, সৃষ্টিশীল মানুষরা একটু বাউণ্ডুলে স্বভাবের হয়। মাটির প্রতি টান থেকেই মানুষ লেখক হয়। সাহিত্যিক হয়। এটা অনেকটা অস্তিত্ববাদের সঙ্গে যুক্ত। আমি চলে যাব। কিন্তু আমার সৃষ্টি থেকে যাবে মৃত্যুর পরেও। আর যিনি বাংলা ভাষায় লেখালেখি করেন, তিনি তো বাংলার মাটিতে ফিরতে চাইবেনই। শুধু যে লেখকরা নন, সাধারণ মানুষরাও ফিরতে চান শিকড়ে। নিজের দেশে কবর মানে যেন মায়ের কোলে ঘুমানো।’
তাজুল ইমামের সঙ্গে কথা বলে ফোন করি বেলাল বেগকে। উনি ইংল্যান্ড-বাংলাদেশের ক্রিকেট ম্যাচ দেখা নিয়ে মহা ব্যস্ত। হাজার মাইল দূরে থেকেও মানুষ কতখানি আকুল হয়ে দেখে বাংলাদেশের খেলা। এখন তো রাজা-বাদশার লড়াই হয় না যুদ্ধক্ষেত্রে। যুদ্ধ হয় খেলার মাঠে। আর স্টেডিয়ামের গ্যালারির উত্তেজিত দর্শকদের দেখলে বোঝা যায়, মানুষ কত ভালোবাসে নিজের দেশকে। যে ভালোবাসা পৃথিবীর যে প্রান্তেই যাক না কেন মানুষের শেষ হয় না। পরানের গহিন ভেতরে লাল-সবুজ পতাকা উড়িয়ে বেলাল বেগ বললেন, ‘যেখানে জন্ম হয়, শৈশবের দিনগুলো কাটে, জীবনের সমস্ত ধারণাগুলো গড়ে ওঠে, সেখানে বারবার ফিরে যেতে চায় মানুষ। ঘুমে-জাগরণে সেই জায়গাটার ছবি দেখে মানুষ।’
বেলাল বেগের নিজেরও খুব যেতে ইচ্ছা করে সন্দ্বীপে নিজ গ্রামে। তার গ্রামের নাম সন্তোষপুর। সুজলা-সুফলা, শস্য শ্যামলা গ্রাম। তার বাড়ি থেকে পশ্চিম দিকে এক মাইল গেলে সমুদ্র। আর পূর্ব দিকে চার মাইল গেলে সমুদ্র দেখা যায়। বেলাল বেগ জানান, ‘খুব ইচ্ছে জীবনের শেষ দিনগুলো গ্রামের বাড়িতে কাটানোর। জানিনা সেটা সম্ভব হবে কিনা!’
কেন এই আকুল বাসনা ঘরে ফেরার। যত ওপরেই কিছু ছুঁড়ে মারা হোক, সেটা যেমন আবার মাটিতে ফিরে আসে, মানুষ যেন তেমনই। যত দূরেই যাক। আবার ফিরে যেতে চায় মাটির কোলে। কেমন একটা মায়ার শৃঙ্খল থেকে যায়। পৃথিবীর টানকে বলে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি। মানুষের জন্য এটা মায়ার শক্তি। কেউ ফিরতে পারে। কেউ পারে না। কবি মোহন রায়হান বলেন, ‘বাড়ি ফেরা হল না আমার/অথচ ফিরবো বলে বুকের ভেতরে আকুলতা/ আমাকে জাগিয়ে রাখে সারারাত/ মাইলের পর মাইল হেঁটেছি/ স্বপ্নের ভেতরে কেঁপে ওঠা ঘরবাড়ী/ আগ্রহের সবুজ সীমানা/ আমার চোখের স্তব্ধ জল/ সব যেন ঘন কুয়াশার মধ্যে ডুবে যাচ্ছে/ আমি পথ ভুলে গেছি/ ধু ধু প্রান্তরে দাঁড়িয়ে আছি যেন নিঃসঙ্গ চাতাল।
বাড়ি ফিরতে না পারলেও শয়নে স্বপনে জাগরনে তার মাথায় ঘুর্ণিত হয় বাড়ির রূপ। খুটিনাটি সবকিছু তার চোখে ভাসে সব সময়। রাতে ঘুমের মধ্যেও দেখতে পান। তাইতো একটু পরেই কবি বলেন, ‘আমার বাড়ির পথ হালটের/ দুপাশে বাঁশের ঘনবন/ মমতায় নুয়ে থাকে/পথের ধুলোর সাথে কানাকানি হয়/ কখনও কাশবন, কাঁটাঝোপ, বেতঝাড়/ আমার বাড়ির পথ সারাদিন আগলে রাখে/ আমি বাড়ি ফিরবো….বাড়ি ফিরবো…বাড়ি ফিরবো। /
‘আপা, আপনার দেশের বাড়ি কোথায়?’
এখানে নিউইয়র্কে এসে এই প্রশ্নটার মুখোমুখি হতে হয় প্রতিদিনই। কোনো মানুষ অপরিচিত হোক বা অল্প পরিচিত হোক, এই প্রশ্ন করবেই। আমার নাম কী, বাবা-মায়ের নাম কী, প্রথমে জানতে চায় না মানুষ। শুরুতেই জানতে চায়, দেশের বাড়ির কথা। জানতে চায় অপরিচিত মানুষটার শিকড়ের কথা। দেশের বাড়ি মানে বাংলাদেশে কোনো এলাকার মানুষ আপনি। তারপর যদি শোনে সে তারই এলাকা থেকে এসেছে, তখন একটা অদ্ভুত আনন্দ কাজ করে ওই লোকটার চোখে-মুখে। আহারে! এই অচেনা শহরে নিজ অঞ্চলের একজন মানুষ পেলাম!
এই শহরে ঘুরে বেড়ানো মানুষদের সুখী চেহারাই দেখে সবাই। কী এক অদ্ভুত আবেগ সারাক্ষণ বুকের মধ্যে খামচে থাকে সেই খবর কে রাখে! কণ্ঠে বাড়ি ফেরার বেদনা দলা পাকায়। হু হু করে ওঠে মন। বৈরাগী মন শুধু কাঁদে ফিরে যেতে। স্বেচ্ছায় নির্বাসিত কবি শহীদ কাদরী যখন লেখেন- ‘ব্যক্তিগত গ্রাম থেকে অনাত্মীয় শহরে/ পুকুরের যৌথ স্নান থেকে নিঃসঙ্গ বাথরুমে/ কোন নির্বাসনই কাম্য নয়’, তখন বোঝা যায় কবিকে কতখানি কষ্ট দেয় জন্মভূমি থেকে এই দূরে থাকা।
ডিসেম্বর মাসে নিউ ইয়র্ক শহরে বিজয় দিবস নিয়ে অনুষ্ঠানের ঘনঘটা বলে দেয়, আপন দেশ-আপন দেশের সংস্কৃতিকে কতখানি ভালোবাসে মানুষ। লাল-সবুজ পোশাক পরে নারী-পুরুষরা যায় সেই সব আয়োজনে। আসলে এই পরবাস জীবন কেউ মেনে নিতে পারে না। জীবন-জীবিকার তাগিদে মানুষ পাড়ি দেয় ভিন দেশে। বুকে থাকে দীর্ঘশ্বাস। থাকে অভিমান। কবি শহীদ কাদরী যেমন অন্য এক কবিতায় লিখেছেন-
দু টুকরো রুটি কিংবা লাল শানকি ভরা ভাত
এবং নক্ষত্রকুচির মতন কিছু লবণের কণা
দিগন্তের শান্ত দাওয়ায় আমাকে চাও নি তুমি দিতে-
তাই এই দীর্ঘ পরবাস!
কবি শহীদ কাদরী ১৯৭৮ সালে প্রথমবার দেশত্যাগের পরে আবার ফিরেছিলেন জন্মভূমিতে। সেটা ১৯৮২ সাল। কিন্তু সেভাবে থিতু হতে পারেননি। পরে আবার পরবাসী হন। তাইতো তার কবিতায় ঝরেছে তীব্র অভিমান-
যতবার আমি ঘরের নিকটবর্তী হই
কুয়াশায় আক্রান্ত সেই বারান্দায় রয়েছে দাঁড়ানো আজো
একটা অস্পষ্ট ছায়ামূর্তি- একদা কৈশোরে
যে আমাকে জানিয়েছিল বিদায়, সেই ছায়ামূর্তি
আজো, এখনো, আমাকে লক্ষ্য করে উড়িয়ে চলেছে
একটি বিদায়ী রুমাল।
সব্যসাচী লেখক যিনি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরে বাংলা ভাষায় যার মতো বহুমুখী প্রতিভার দেখা মেলেনি, সেই সৈয়দ শামসুল হককে দাফন করা হয়েছে কুড়িগ্রামে নিজ এলাকায়। বারবার তার কবিতায় প্রকাশ পেয়েছে সেখানে ফেরার আকুতি-
আবার তোমার কোলে ফিরা যায় তোমার সন্তান,
আবার তোমার কোল, খালি কোল, উথলায়া পড়ে
দুধের ঘেরানে ভরা, জননী গো, পুন্নিমার চান-
আবার সে ঘরে আইসাছে সারাদিন পরে।
আবার সে আইসাছে করালের ঘুম চক্ষে নিয়া,
চক্ষের ভিতরে তার গেরেপ্তার বিহানের সোনা,
তবনের নীল খোপে শিমুলের লাল রং নিয়া,
আবার সে আইসাছে, জননী গো, তুমি কাইন্দো না।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর